একান্ত সাক্ষাৎকারে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক অপরিহার্য
১৩ মার্চ ২০২৫ ২১:৫০ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫ ২২:৩৫
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। বাংলাদেশের একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। ১৯৫১ সালের ১ নভেম্বর ঢাকার কেরাণীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল গঠন হলে তিনি যুবদলে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে যুবদলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি টেকনোক্র্যাট কোটায় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর পর তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও পরবর্তী সময় স্থায়ী কমিটির সদস্য মনোনীত হন।
সম্প্রতি সারাবাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। বিশেষ করে ভারত ইস্যুতে বিএনপির বর্তমান অবস্থান, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক, নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)’ এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরেছেন বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ। তার এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট আসাদ জামান। নিচে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
সারাবাংলা: ভারত-বিএনপির সম্পর্ক এখন কেমন?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: বাংলাদেশ গ্লোবাল ভিলেজের মেম্বার। জনগণের স্বার্থ বা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট যেগুলো আছে, সেগুলোকে রক্ষা করে সবদেশের সঙ্গে আমাকে বন্ধুত্ব করতে হবে। আমার পণ্য যেমন বিদেশে দিতে হবে, আবার অন্যের পণ্য আনতে হবে। অর্থাৎ যেগুলো আমাদের নাই, সেগুলো তো আনতে হয়। সুতরাং পার্টুকুলারলি কোনো দেশের সাথে সম্পর্ক থাকবে বা কোনো দেশের সঙ্গে থাকবে না, তাতে তো একটা রাষ্ট্র চলতে পারবে না।
সারাবাংলা: স্পেসিফিক্যালি ভারতের বিষয়টা একটু বলুন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক অপরিহার্য, গুরুত্বপূর্ণ। এখন প্রশ্ন হলো যে, প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যে থাকবে বা করব, তার আগে বুঝতে হবে আমার কোনো অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কিনা; তাই না? আমার অধিকার বা ইন্টারেস্ট সংরক্ষণ করার মাধ্যমে অবশ্যই প্রতিবেশীর সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক রাখব। প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করাটা আমাদের জন্য মানানসই না— এটা আমি বিশ্বাস করি।
সারাবাংলা: বিগত বছরগুলোতে আপনারা পরিষ্কারভাবে ভারতবিরোধী অবস্থানে ছিলেন!
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: গত ১৬/১৭ বছর ধরে ভারতের সঙ্গে যে সম্পর্ক, অথবা ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত ভারতের সাথে যে সম্পর্কটা, এই সম্পর্ক অনেটাই ‘সকল দরজা খুলে দেওয়ার মতো সম্পর্ক’ ছিল। সেই দরজা দিয়ে কী চলে যাচ্ছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বার্থকে গুরুত্ব না দেওয়া, ভারতকে খুশি করা, তুষ্ট করা আর দেশের মানবাধিকার, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। এই ক্ষোভটা কিন্তু আওয়ামী লীগের পাশাপাশি ভারতের ওপরও পড়েছে। এখান থেকে আমাদের ফেরত আসতে হবে, তাই না? পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। তাদের শুধু আমরা দেব, তারা আমাদের কিছু দেবে না, সেটা তো আর বন্ধুত্ব হলো না।
সারাবাংলা: কিন্তু আপনাদের অবস্থান তো পরিষ্কার না। আপনারা একদিকে ভারতীয় পণ্য বয়কট করছেন, গায়ের চাদর পুড়িয়ে দিচ্ছেন, ভারতীয় শাড়িতে আগুন দিচ্ছেন, অন্যদিকে দিল্লিতে গিয়ে আপনাদেরই একজন শীর্ষ নেতা ভারতের ক্ষমতাসীন দল ‘ভারতীয় জনতা পার্টির’ (বিজেপি) সভাপতি অমিত অনিলচন্দ্র শাহ’র সঙ্গে মিটিং করছেন!
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: রাজনীতিতে একটা দৃশ্যমান ব্যাপার থাকে। আবার সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য একটা কূটনৈতিক তৎপরতা থাকে। কোনোটাকেই নেতিবাচক দেখার দরকার নেই। আবার কোনোটাকেই খুব বেশি ইতিবাচক হিসেবে দেখার দরকার নেই।
সারাবাংলা: ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন কি?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: ৫ আগস্টের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক হওয়া দরকার এখনো সেটা হয়নি। ক্ষমতায় থাকলে সুন্দর সুন্দর কথা বলা যায়, এই আরকি। কিন্তু, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এ সরকারের কোনো উদ্যোগ আছে কিনা আমি জানি না। যদি থাকে, এবং তারা কতটুকু সফল সেটা জনগণের কাছে তো দৃশ্যমান না। হয়তো যারা সরকারে আছে, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু, দেশের জনগণের সঙ্গে যে সুসম্পর্ক দরকার, সেটা সৃষ্টি হয়নি। এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার সময় এখনো আসেনি।
সারাবাংলা: ভারত নাকি বিএনপির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে চায়?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: গত ১৬ বছর যেমন ছিল, সেখান থেকে যদি ভারত সরে আসতে চায়, সেটা তো বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে। বিষয়টা হলো যে, বর্তমান যে ভারত শাসন করছে, ওরা একটা মৌলবাদী শক্তি। কিন্তু, ভারতের জনগণ মৌলবাদী না। এই কারণে ভারতের বর্তমান সরকার বেকায়দায় আছে। পাশাপাশি ভারতের জনগণ এবং মিডিয়া প্রাণান্ত চেষ্টা করছে উপমহাদেশে যেন মৌলবাদের উত্থান না হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি সম্পর্কে আবলতাবল বলে একটা ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু, মৌলবাদের যে ডেফিনেশন সেখানে বিএনপিকে ফেলা যায় না। সেদিক থেকে ভারত যদি বিএনপিকে নিরাপদ মনে করে, এটা বিএনপি এবং ভারত উভয়ের জন্যই ভালো।
সারাবাংলা: বিএনপি সম্পর্কে ন্যারেটিভ তৈরির মিশন কি থেমে গেছে, নাকি চলছে?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: না, থেমে যায়নি, ওটা চলছে। যারা এগুলো করছে- জনপ্রিয়তা, জসমর্থন এবং সাংগঠনিক শক্তির দিক দিয়ে তারা বিএনপিকে মোকাবেলা করার মতো শক্তি না। ন্যারেটিভ ক্রিয়েট করার জন্য কিন্তু অনেক লোক লাগে না। সামান্য কিছু লোকই ন্যারেটিভ ক্রিয়েট করতে পারে। তারা কিছু কথাবার্তা বলছে, যেটা আমরা ধৈর্যের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছি। কারণ, কারও পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে গণাতিন্ত্রক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার সময়টাকে দীর্ঘ করতে চাই না। সে কারণে হয়তো আমাদের কথা-বার্তায় একটু সংযতবোধ লক্ষ্য করছে সবাই। কেউ হয়তো মনে করতে পারে, আমরা কারও সঙ্গে পিরিত করছি। ঘটনা কিন্তু তা না। যারা উগ্রবাদী কথাবার্তা বলছে, তাদের হয়তো অন্য কোনো ঘটনা ঘটানোর চিন্তা থাকতে পারে। এই সরকারকে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব একটা নির্বাচন করানোর চেষ্টা আমরা করছি, আর কিছু না।
সারাবাংলা: নতুন দল এনসিপি নিয়ে কিছু বলুন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: এই দেশে ছাত্র আন্দোলনের যে ঐতিহ্য, সেটা কিন্তু তারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিল এবং প্রশংসায় ভেসে যাচ্ছিল। কিন্তু, এদের (জামায়াত) খপপরে পড়ে তারা সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয় কিনা, এটার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আবেগের মধ্য দিয়ে তারা যেসব কথাবার্তা বলছে, তাতে তারা সবকিছু হারাতে পারে। এটা আমার ব্যক্তিগত মত।
সারাবাংলা: কেন এমন মনে হচ্ছে আপনার?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: ইন্ডিয়ান একটা পত্রিকায় দেখলাম, তাদের (এনসিপি) ব্যাপারে যে প্রশ্নগুলো উঠছে, এগুলো আমাদের দেশের মিডিয়া না তুললেও জনগণ কিন্তু অনুমান করে, তারা একটু খারাপ দিকে চলে গেছে। সুবিধা গ্রহণ করা, মানুষের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার শক্তি ওদের হয়নি, তারপরও হুমকি-ধামকি দেওয়া। আমার মনে হয়, জামায়াত ওদের ওপর ভর করছে। অথবা ওরা জামায়াতের ওপর ভর করছে। এটা ভালো লক্ষণ না।
সারাবাংলা: এনসিপির কোন দিকগুলো খারাপ মনে হচ্ছে?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: ওদের অ্যাটিটিউড। এই অ্যাটিটিউডই ওদের ধ্বংস করে দিতে পারে। এই অল্প বয়সে অমার্জিত কথাবার্তা, এটা তো মানুষের মনে দাগ কাটছে। রাজনীতিতে এরা টিকতে পারবে না তো। রাজনীতি তো ম্যারাথন রেস। রাজনীতি নট এ হান্ড্রেড মিটার রেস। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় সফলতার জন্য। ম্যারাথন রেস মানে দৌড়ানোর দরকার নাই। হাঁটতে পারলেই হয়। আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকলে শেষ প্রান্তে গিয়ে তারা পৌঁছাতে পারে। আর ১০০/২০০ মিটার হলো দৌড়, যে দ্রুত যেতে পারে। তারা যেটা করছে, এটা আমার কাছে ১০০ মিটারও মনে হয় না। এটা ৫০ মিটার মনে হচ্ছে।
সারাবাংলা: বর্তমান কাল আর আপনাদের কালের মধ্যে পার্থক্য কী?
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: আমি ৬২ সাল থেকে রাজনীতিতে সক্রিয়। এমন কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম নাই যেখানে অগ্রভাগে ছিলাম না। ওরা তো আমার ছেলে-মেয়ের বয়সেরও না। নাতির বয়সী। আমি রাজনীতি করি ৬০ বছর। তার পরও তো ওদের মতো কথা বলি না।
সারাবাংলা: আপনাকে ধন্যবাদ
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়: আপনাকেও ধন্যবাদ
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম