Saturday 15 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিল্কের ঐহিত্য ফেরাতে চলছে রেশম উৎপাদন, বেড়েছে বিক্রি

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৫ মার্চ ২০২৫ ১০:৪৯ | আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫ ১৩:২৫

রেশম পোকার গুটি থেকে প্রথমে সূতা তৈরি করা হয়। ছবি: সারাবাংলা

রাজশাহী: সিল্ক মানেই কাপড়ের জগতে দেশজুড়ে বাড়তি কদর। এ জন্য রেশম নগরীও বলা হয় রাজশাহীকে। সিল্কসিটি নামে আছে একটি ট্রেনও। প্রতিটি উৎসবে সিল্ক কাপড়ের যেন জুড়ি মেলে ভার। অন্যান্য কাপড় যত দামিই হোক না কেন, তার সঙ্গে একটা সিল্ক কাপড় থাকলে সেটিই আগে পছন্দের তালিকায় রাখেন বাঙালি বধূরা। ফলে ঈদ এলে সিল্ক কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায় আরও কয়েক গুণ। বিশেষ করে যারা সামর্থ্যবান পরিবার এবং সিল্ক কাপড়ের প্রতি যাদের আগ্রহ বরাবর থাকে, তাদের মধ্যে ঈদের সময় এই কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ফলে এবার ঈদকে ঘিরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

বিজ্ঞাপন

তবে সিল্কের কাপড়র উৎপাদন যদি হয় সরকারিভাবে তাহলে তো কথায় নেই। এর চাহিদা যেমন বাড়ছে ঠিক তেমনই বাড়ছে বিক্রিও। শুধু রাজশাহী নয়, এর চাহিদা এখন দেশজুড়ে। রাজশাহী রেশম কারখানা থেকে সরাসরি হচ্ছে কাপড় উৎপাদন। বিক্রি করা হচ্ছে নিজস্ব শোরুমে। এখান থেকে অনেক ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন কাপড়। ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকেও আসছেন এখানে কাপড় কিনতে।

কাপড় বোনার আগে রেশম সূতা এভাবেই মেশিনে প্রস্তুত করা হয়। ছবি: সারাবাংলা

কাপড় বোনার আগে রেশম সূতা এভাবেই মেশিনে প্রস্তুত করা হয়। ছবি: সারাবাংলা

‘বনের পাতা খেয়ে পোকা দেয় সোনার টাকা’- সিল্কের জন্য সবচেয়ে প্রচলিত প্রবাদ এটি। রাজশাহী অঞ্চলে সরকারি তত্ত্বাবধানে ১৯৫২ সালে রাজশাহী সিল্কের যাত্রা শুরু হয় যা বাংলাদেশে প্রথম। রাজশাহী রেশম কারখানা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা, যা ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৮ সালের পর এই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পটি রেশম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে আসে। লোকসানের মুখে এক পর্যায়ে ২০০২ সালের ৩০ নভেম্বর এ কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবশ্য ১৬ বছর পর ২০১৭ সালের শেষ দিকে পরীক্ষামূলক পুনরায় এটি চালু করা হয়। কারখানাটি চালুর পর এর ৪২টি লুম মেরামত করা হয়। বর্তমানে এর ১৯টি লুমে ৪১ জন শ্রমিক ও তাঁতি কাপড় উৎপাদন করছেন। চালু হয়েছে বন্ধ শোরুমও। এই শোরুমে বিক্রি হচ্ছে সরকারি কারখানার পোশাক।

এভাবেই লুমে রেশম সূতা তুলছিলেন এক কারিগর। ছবি: সারাবাংলা

এভাবেই লুমে রেশম সূতা তুলছিলেন এক কারিগর। ছবি: সারাবাংলা

রেশমের গুটি থেকে বের করা হচ্ছে সুতা। বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড প্রতিবছর এই গুটি চাষের মাধ্যমে উৎপাদন করছে। বোর্ডের তথ্যনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেশম গুটি উৎপাদন করা হয়েছে ১৩৪ দশমিক ৬২ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯১ দশমিক ৯০, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬৬ দশমিক ১৭, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৮৬ দশমিক ৩২, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৪৫, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১৫, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২২৪ দশমিক ৬৪, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৪৯ দশমিক ১৬ মেট্রিক টন গুটি উৎপাদন হয়েছে। এ ছাড়াও চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ৭৩ দশমিক ২০ মেট্রিক টন।

বিজ্ঞাপন

রেশম চাষিদের উৎপাদিত গুটি কিনে মিনিফিলেচার কেন্দ্রে করা হয় সুতার উৎপাদন। বোর্ড থেকে এই তথ্যও দেওয়া হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সুতা উৎপাদন করা হয়েছে ৭৯৩ কেজি। এ ছাড়া, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৯৩১ কেজি, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ১ এক হাজার ৫৯ কেজি, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ১ হাজার ৪৩৮ কেজি, ২০২০-২১ অর্থবছরে এক হাজার ৮৫ কেজি, ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ২৬৬ কেজি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক হাজার ২৫৪ কেজি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৮৯ কেজি সুতা উৎপাদন করা হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ৬২০ কেজি সুতা।

এভাবেই লুম থেকে বেরিয়ে আসে মহামূল্যবান রেশম কাপড়। ছবি: সারাবাংলা

এভাবেই লুম থেকে বেরিয়ে আসে মহামূল্যবান রেশম কাপড়। ছবি: সারাবাংলা

সরেজমিনে রাজশাহী রেশম কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রথমে গুটি থেকে সুতা উৎপাদন করছেন। সেই সুতা থেকে তাঁতযন্ত্রে (লুম) গিয়ে বোনা হচ্ছে কাপড়। তারপর এই কাপড় বিভিন্ন রঙে নিয়ে আসা হচ্ছে। তারপর করা হচ্ছে বিভিন্ন রকমের প্রিন্ট। আকার ঠিক করে শোরুমে যাচ্ছে বিক্রির জন্য। এই কারখানা থেকে প্রতি মাসে ২৫০ মিটার কাপড় উৎপাদন করা হচ্ছে।

রেশম বোর্ডের শোরুমও কারখানার সঙ্গে লাগোয়া। রাজশাহী নগরীর শিরোইল এলাকায় রেল স্টেশনসংলগ্ন বিশাল জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছে এই কারখানা। শোরুমে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে পোশাক। গরদের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে আট হাজার টাকায়। টাইয়ের কাপড় এক হাজার ৫২০ টাকা গজ। ২/২ গ্রে-থান ৭৫০ টাকা গজ। প্রিন্টেড শাড়ি বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ হাজার টাকায়। নারীদের টু-পিস ৩ হাজার ৮৯০ টাকায়। ওড়না বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৯২৫ টাকায়। স্কার্ফ বা হিজাব প্রতিটির দাম ৯৬০ টাকা।

কাপড় বোনার পর, সেই কাপড়ে বিভিন্ন আল্পনা আঁকেন কারিগররা। ছবি: সারাবাংলা

কাপড় বোনার পর, সেই কাপড়ে বিভিন্ন আল্পনা আঁকেন কারিগররা। ছবি: সারাবাংলা

এছাড়াও গজ হিসেবে কাপড় বিক্রি করা হয়। যা থেকে শার্ট, পাঞ্জাবি, নারীদের ওয়ানপিসও তৈরি করা যায়। স্ট্রাইপ সুপার বলাকা বিক্রি করা হচ্ছে এক হাজার টাকা গজ, সুপার বলাকা ৯৫০ টাকা গজ, ডুপিয়ন সার্টিন (টাইডাই) প্রতি গজ ৯০০ টাকা, ডুপিয়ন সার্টিন ৮৫০ টাকা, ২/৪ গ্রে-থান ৯৫০ টাকা, মটকা থান ৯৩৮ টাকা গজে বিক্রি করা হচ্ছে।

২০০৫ সালে এক কেজি সুতার দাম ছিল এক হাজার টাকা। বর্তমানে সেই সুতার দাম কেজিপ্রতি সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বর্তমানে রেশম উন্নয়ন বোর্ড নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকা কেজি দরে দেশি সুতা বিক্রি করছে বেসরকারি কারখানা মালিকদের কাছে।

রেশমের উন্নয়নে সরকারিভাবে কয়েকটি প্রকল্প চালু রয়েছে। সুতার চাহিদা মেটাতে প্রতি বছরই তুঁতগাছ লাগানো হচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যেই রেশম সুতার উৎপাদন বাড়বে। তখন দেশি সুতাতেই শতভাগ রেশম তৈরি হবে। দেশের জিআই পণ্য হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে রাজশাহী সিল্ক। ক্রেতার চাহিদা ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ঐতিয্যবাহী রাজশাহী সিল্কের আরও বেশি প্রচার ও প্রসার ঘটানো সম্ভব।

রাজশাহী রেশম কারখানার অপারেশন ইনচার্জ সাইদুল ইসলাম টুটুল বলেন, ‘বর্তমানে ১০টি লুমে কাপড় উৎপাদন চলছে। এই লুমগুলোও অনেক পুরনো। এখানে কাপড় উৎপাদনে অনেক ধীরগতি। তারপরও আমরা প্রতি দিন এখানে পাঁচ থেকে ১০ গজ কাপড় উৎপাদন করছি। নানা প্রতিবন্ধকতায় এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এখানে শতভাগ রেশমের কাপড় পাওয়া যায়।’

রাজশাহী রেশম উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ড. এমএ মান্নান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের রেশম শিল্পের উন্নয়ন হচ্ছে। রেশমের উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প গড়ে উঠবে। আগামীতে ১৫ কোটি টাকার সবুজ পাতার একটি প্রকল্প ও বাস্তবায়ন হলে রেশম শিল্পের আরও উন্নয়ন হবে। আমরা বেশকিছু নতুন মাতৃজাত উদ্ভাবন করতে পেরেছি। আমাদের ১১৪টি জাত রয়েছে। তুঁতের জাত ৭৩টি থেকে ৮৪টি করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনায় কারখানাকে আরও উন্নত করা হবে। যা ইতিমধ্যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। জমি বাড়িয়ে তুঁত চাষের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। শতভাগ সিল্ক আমরা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চায়। রেশম রাজশাহীর একটি ব্র্যান্ড তা আবারও পরিচিত হয়ে উঠবে।’

সারাবাংলা/পিটিএম

বিক্রি রাজশাহী রেশম কারখানা সিল্ক উৎপাদন