Saturday 22 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তাঁতের মাকুর শব্দে মুখরিত মিরপুরের বেনারসিপল্লি

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২২ মার্চ ২০২৫ ১০:০০ | আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫ ১০:৫৯

ঈদকে ঘিরে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁত কারিগররা

ঢাকা: তাঁতের মাকুর খটখট শব্দে মুখরিত এখন মিরপুর বেনারসিপল্লির তাঁতি পাড়া। গভীর রাত পর্যন্ত শোনা যায় মাকুর আওয়াজ। ঈদ-উল-ফিতরকে কেন্দ্র করেই তাদের কর্মব্যস্ততা বেড়েছে বহুগুণ। বাহারি শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁত কারিগররা।

সরেজমিনে দেখা যায় তাঁতগুলোতে বেড়েছে ব্যস্ততা। তাঁত শিল্পীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন রাতদিন। মেশিনের ওপরে কার্ডবোর্ডে ছাপানো আছে নকশা। এই নকশা দেখেই পা দিয়ে চালানো হয় তাঁতযন্ত্র। হাত দিয়ে চলে মাকুর। আর এভাবেই ওঠানো হয় নকশা। কষ্টটা অনেক বেশি হলেও তাঁত শিল্পীরা বছরের পর বছর ধরে রেখেছেন এই কাজের ঐতিহ্য।

বিজ্ঞাপন

তাঁত শিল্পীরা বছরের পর বছর ধরে রেখেছেন এই কাজের ঐতিহ্য

৪৭ বছর বয়সী তাঁত কারিগর সাব্বির। ৩০ বছর ধরেই এই পেশার সঙ্গে জড়িত। সারাবাংলাকে সাব্বির বলেন, ‘আমি ৩০ বছর থেকেই এই পেশায় জড়িত। আমার কাছে এই কাজ করতে অনেক ভালো লাগে। আমার হাতে কাজ করা নকশার শাড়ি মানুষের পছন্দ হলে আমার ভালো লাগে। আমার মনে হয়, এই কাজগুলো একটা আর্ট। একটা মানসিক প্রশান্তি। কাজ করে সেই তৃপ্তিটা পাই। তবে কাজ করতে কষ্টও আছে। কায়িক পরিশ্রমতো হয়ই। নকশাগুলো অনেক সুক্ষ। প্রখর দৃ্ষ্টি দিয়ে কাজ করতে হয়। চোখ, মাথা, শরীর ব্যথা করে। কিন্তু কাজ করতে করতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।’

তাঁত পাড়া ঘুরে জানা যায়, এখানে তৈরি প্রতিটি শাড়িতেই রয়েছে আভিজাত্যের ছাপ। এসব শাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো পাকা রং আর ওজনে হালকা। এইসব তাঁত কারখানায়, নিজেদের মতো নকশা ও রঙ বাছাই করে দিয়ে অর্ডার দেওয়া যায়।

এ বিষয়ে কারিগর হাতিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা পাইকারি অর্ডারতো সবসময়ই নেই। সেইসঙ্গে, খুচরা কাস্টমারদের অর্ডারও নেই। অনেক কাস্টোমার নিজে কারখানায় এসে অর্ডার দিয়ে যায়। আমি যেই শাড়িটা লাল রঙ এর মধ্যে করেছি; সেই শাড়িটা দেখা যায়, তারা গোলাপী রঙ এর মধ্যে চায়। আমরা সেটা করে দিতে পারি। আবার নকশার মধ্যেও পছন্দ ডিজাইন দিলে, সেটার আমরা করে দেই। এই ঈদে বেশি লাল আর মেজেন্টা রঙ এর মধ্যে অর্ডার পেয়েছি।’

বিজ্ঞাপন

প্রখর দৃষ্টি দিয়ে কাজ করতে হয় তাঁত কারিগরদের

আরেক কারিগর সোলেমান বলেন, ‘একটি শাড়ি তৈরি করতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। আবার বেশি কারুকার্য ওলা শাড়ি করতে সময় লাগে ৭-১০ দিন। একটি বেনারসি শাড়ি তৈরি করে সপ্তাহে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আয় হয়। এখন ঈদের সময়, তাই ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে সপ্তাহে দুটি শাড়ি তৈরি করি। অনেক সময় ১৫-১৬ ঘণ্টাও কাজ করি। যত শাড়ি বানাতে পারব, ইনকাম ততো বেশি পাবো সেই আশায়।’

শুধু শাড়িই নয়। বিন্দিয়া কাতান, পিওর বেনারসি শাড়িতে বিশেষ কারুকাজ, আনারকলি ও ফুলকলি ছাড়াও নেট কাতান, পিওর কাতান, বেনারসি জুট জামদানি, কুচি জামদানি, মাসরাইস কাতান, ওপেরা কাতান, লেহেঙ্গা শাড়ি ও বিভিন্ন মানের থ্রি-পিস তৈরি করছে তাঁতিরা।

প্যারিস বাবু বর্তমানে ৫০টি তাঁত কারখানার মালিক। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এই তাঁতযন্ত্রে তো হাতের কাজ হয়। অর্থাৎ মেশিন তাঁত কারিগররা নিজেদের হাত ও পা দিয়ে চালিয়ে তৈরি করে। হাতে বুনলে এক শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে ৭ থেকে ১০ দিন। এজন্য, ঈদকে সামনে রেখে আমরা এক মাস আগে থেকেই প্রস্তুতি নেই। অর্থাৎ রোজারও ১৫ দিন আগে থেকে নকশা ও শাড়ির মান নির্ধারণ করে একসঙ্গে ৫-১০ হাজার শাড়ি বানিয়ে মার্কেটগুলোতে ছেড়ে দেই। আবার ১০ হাজার শাড়ি একবারে ছাড়ি না। ভাগে ভাগে দেই একেক মার্কেটে একেকভাবে। এরপর বিক্রির ওপর নির্ভর করে, নতুন শাড়িতে হাত দেই।’

প্যারিস বাবু আরও বলেন, ‘রোজার মধ্যে কাস্টমারদের একক অর্ডার কম নেই। হাতে কাজ কম ও চাহিদার ওপর নির্ভর করে নেই। আবার অনেক কাস্টমার একসঙ্গে একই ডিজাইনের ৫-১০টা শাড়ির অর্ডার যদি দেয়, তখন অর্ডার নেই। কিন্তু ১-২টা শাড়ির অর্ডার ঈদের মধ্যে নিয়ে পোষায় না।’

বাহারি রঙয়ের, বাহারি নকশার শাড়ি বানাতে ব্যস্ত কারিগররা

তাঁত মালিকদের দেওয়া সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের পর ভারতের বেনারস থেকে বেশ কিছু মুসলিম পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তাদের মধ্যেই হারুন শেঠ নামে এক ব্যবসায়ী প্রথম বেনারসি তাঁত সামগ্রী আমদানি শুরু করেন। তারই হাত ধরে শুরু হয় মিরপুরে বেনারসি শিল্পের যাত্রা। দেশ স্বাধীনের পর এ শিল্পের প্রসার ঘটলেও আশির দশকের শেষের দিক থেকে দেশ ও দেশের বাইরে মিরপুরের তৈরি বেনারসি শাড়ির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণত বিয়ের জন্য এই শাড়ি বেশি ব্যবহার হয়। কিন্তু ঈদকে সামনে রেখেও সকল বয়সী নারীদের শাড়ির জায়গায় পছন্দ এই বেনারসি শাড়ি।

ঈদ যত এগিয়ে আসবে তাঁত থেকে শাড়ি ওঠার সংখ্যা তত বাড়বে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোর বিপণীবিতানে এখানকার শাড়িগুলোই ২০-৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সারাবাংলা/এফএন/এইচআই

ঈদ ঈদের পোশাক কারিগর তাঁত কারিগর তাঁত শিল্প বেনারসিপল্লি মাকুর মিরপুৃর শাড়ি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর