ভয়াল গণহত্যার কালরাত ২৫ মার্চ আজ
২৫ মার্চ ২০২৫ ০৯:০০ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫ ০৩:৪৫
ঢাকা: ২৫ মার্চ জাতির জীবনে এক বিভীষিকাময় রাত। শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তখন গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ। স্বাধীনতার স্বাদ নিতে উন্মুখ। অপেক্ষা শুধু চূড়ান্ত নির্দেশের। সেই নির্দেশ এলেই জাতি জীবনবাজি রাখবে স্বাধীনতার জন্য মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঠিক এমন সময় নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে এক নীলনকশা অনুযায়ী তারা গভীর রাতে ঢাকায় নেমে এলো দানব হয়ে। স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু করার আগেই বাঙালি জাতির কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে হামলে পড়ে তারা। মেতে উঠল রক্তের হোলিখেলায়।
বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধে ঠিকই বাঙালি ছিনিয়ে এনেছে মুক্তির স্বাদ। কিন্তু এর ঠিক আগ মুহূর্তে সেই ভয়াল রাতে তারা নির্মম গণহত্যা চালায় ঢাকার বুকে। রাতের আঁধারে রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা— আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী সবখানে ঘুমন্ত মানুষের বুকে গুলি চালায়। নজিরবিহীন নিষ্ঠুর এক গণহত্যার ইতিহাসের সাক্ষী হয় বিশ্ব।
সেই ভয়াল ২৫ মার্চ আজ সোমবার। ১৯৭১ সালের এই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে পুলিশ থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ কেউ রেহাই পায়নি। ঐতিহাসিক বিভিন্ন দলিল থেকে জানা যায়, সেই এক রাতেই কমপক্ষে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। কোনো কোনো গবেষকের হিসাবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
জাতীয় সংসদে গৃহীত এক প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সাল থেকে ২৫ মার্চ দিনটিকে জাতীয়ভাবে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। ইতিহাসের ভয়াল এই দিবসটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি পালন করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করবে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ২৫ মার্চের সেই অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়।
অনেক পরে, ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সেই আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
বইটিতে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দু’জন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।’
পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারে করে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসেন।
ঢাকার ইপিআর সদর দফতর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাংক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাংক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের নয় শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও।
‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।’
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও তিন হাজার মানুষকে। ঢাকায় তখন ঘটনার মাত্র শুরু। এরপর পূর্ব-পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশানভূমি।
এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয় , ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনাঅভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে) তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সারাবাংলা/পিটিএম