কর বাড়ানোয় বাজারে বাড়ছে অবৈধ সিগারেট
২৭ মার্চ ২০২৫ ১২:৩২ | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৫ ১৪:২৩
ঢাকা: কর বাড়ানোয় দেশে অবৈধ সিগারেটের প্রসার ঘটছে। অলিগলিতে এখন বিদেশী ব্রান্ডের অবৈধ সিগারেটের হাতছানি। আর এসব আসছে কর ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে। রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান চাপে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে সরকার সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্য দুই দফা বৃদ্ধি করেছে।
আকস্মিক এবং ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাজারে অবৈধ সিগারেটের ব্যবসার ব্যপক প্রসার হচ্ছে এতে করে সরকারের রাজস্ব আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। স্তর ভেদে সিগারেটের সর্বনিম্ন মূল্যে গত অর্থবছর হতে দুই ধাপে ২০ শতাংশ হতে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের মধ্যে সস্তা বিকল্প পণ্য খোঁজার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, যা অবৈধ সিগারেটের বাজারকে ভয়ঙ্করভাবে উৎসাহিত করে তুলেছে। বিশেষ করে, নিম্ন আয়ের ভোক্তারা, যারা দামের প্রতি বেশি সংবেদনশীল, তারা অবৈধ সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে। খাত সংশ্লিষ্টরা এমন তথ্য জানিয়েছেন।
তথ্যমতে, সরকার প্রায়শই অবৈধ সিগারেটের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে, কিন্তু সরকারের বর্তমান অবকাঠামো দ্বারা এই অবৈধ ব্যবসার প্রসার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। এর অন্যতম মূল একটি কারণ হচ্ছে, অবৈধ সিগারেট ব্যবসার বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সরকারি তথ্য-উপাত্ত নেই। যদিও সরকার ধারণা করতে পারে যে মূল্যবৃদ্ধির কারণে সিগারেটের ব্যবহার কমেছে, তবে প্রকৃতপক্ষে এই ব্যবহার অবৈধ বাজারে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এর ফলে একদিকে সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে নিম্নমানের নামি-বেনামি সিগারেট জনস্বাস্থ্যকে আরও হুমকির মুখে ফেলছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সরকার কর ও কর বহির্ভূত রাজস্ব থেকে ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক অনুদান থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিলো। এর বিপরীতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন ব্যয়সহ মোট ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের ফলে বিগত অর্থবছরে ২ লাখ ৩২ হাজার ৯১৮ কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি তৈরি হয়, যা বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পূরণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই বিপুল ব্যয়-নির্ভর বাজেটে ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে রাজস্ব আদায়ের উপর বরাবরই অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। সরকার বিগত বছরগুলোতে প্রতিনিয়তই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জন্য অবাস্তব রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে আসছে ও ফলস্বরূপ এনবিআর-এর রাজস্ব প্রতিবছর বাড়লেও নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছেনা।
তথ্যমতে, গত সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নির্ধারিত ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের বিপরীতে এনবিআর ৪ লাখ ৮ হাাজর ৫৪৫ কোটি টাকা আদায় করেছে, যা সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার ৮৫.৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় সংশোধিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার ৮৪.৫ শতাংশ ছিল। লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্য এনবিআর নতুন নতুন উপায়ে রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এনবিআর কর্তৃক গৃহীত করের আওতা বাড়ানোর অথবা ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও বেশি সংখ্যক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো হতে দৃশ্যমান কার্যকর অথবা ইতিবাচক ফল আসেনি। ফলস্বরূপ, ইতিমধ্যেই নিয়মিত কর প্রদানকারী বৈধ ও প্রচলিত আইনের প্রতি অনুগত ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করে রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। তবে বাস্তবে এটা কোন দীর্ঘ মেয়াদি সমাধান নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের রাজস্বে সর্বোচ্চ অবদান রাখা খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম তামাক খাত। বিগত বছরগুলোতে শুধুমাত্র তামাক খাত নিয়মিত মোট রাজস্বের ১১ শতাংশ এর বেশি অবদান রেখে আসছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে, তামাক শিল্প থেকে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়, বিগত অর্থবছরের তুলনায় যা ১৬ শতাংশ বেশি। তামাকের ওপর উচ্চহারে করারোপের পেছনে স্বাস্থ্য ঝুঁকিকে সবসময় সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ক্রমবর্ধমান বর্ধিত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও এর অন্যতম উদ্দেশ্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ লাখ ৭৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় যা মোট সংশোধিত বাজেটের মাত্র ৫.২ শতাংশ। ২০২১ সালে ৪৫ টি স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ সর্বনিম্ন। এখান থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, তামাক খাত থেকে সংগৃহীত রাজস্ব স্বাস্থ্য খাতের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য বিভিন্ন খাতের জন্যও একটি প্রধান অর্থায়ন উৎস হিসেবে কাজ করে। তামাক খাতের রাজস্বের ওপর এই বিপুল নির্ভরশীলতা, দেশের সামগ্রিক রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা অর্জনে উক্ত খাত হতে প্রাপ্ত আদায়ের টেকসই এবং ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা অবৈধ ব্যবসায়ীদের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি। এমতাবস্থায়, সিগারেটের মূল্য আরও বৃদ্ধি করা হলে অবৈধ সিগারেট ব্যবসায়ীদেরকে বাজারে প্রবেশ করা সহজ করে তুলবে। ফলে দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোর ফায়দা নিয়ে দেশের যত্র তত্র অবৈধ সিগারেট বানানোর কারখানা গড়ে উঠবে। ভীতিকর বাস্তবতা এই যে, এ সকল অবৈধ সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নানা রকম অপরাধী সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্টা বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে ইন্ধন যোগাতে পারে।
মালয়েশিয়ায় ২০১৫ সালে আকস্মিকভাবে ৩৭ শতাংশ কর বৃদ্ধির ফলে বৈধ সিগারেটের দাম রাতারাতি ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে সেখানে অবৈধ সিগারেটের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং মোট সিগারেট বাজারের প্রায় অর্ধেক অবৈধ সিগারেটের দখলে চলে যায়। ১০ বছর পার হয়ে গেলেও মালয়শিয়া এখনো অবৈধ সিগারেটের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ এবং অর্ধেকের বেশি সিগারেটের বাজার এখনও অবৈধ সিগারেট দখল করে রেখেছে। বাংলাদেশেও যদি অবৈধ সিগারেট বাজার এভাবে বিস্তার লাভ করার সুযোগ পায়, তবে তা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত দুরহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে সরকার তামাক রাজস্বের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ায়, এই খাত থেকে ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। একটি খাতের ওপর এরকম নির্ভরশীলতা সিগারেটের মুল্য বৃদ্ধির বিষয়টিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে। যদি সরকার তামাক করের ওপর নির্ভরতা কমাতে সমুচিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে এবং সেই সঙ্গে বর্তমান অবৈধ সিগারেট বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারে, তবে রাজস্ব খাতের অন্যতম নির্ভরযোগ্য উৎস ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আরও বাড়তে থাকবে। একই সঙ্গে নানাবিধ সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রসারের সঙ্গে অবৈধ কর্মকাণ্ডের বৃদ্ধি অনিবার্য।
সারাবাংলা/ইএইচটি/এসআর