কিছু ব্যক্তির বক্তব্য জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে— প্রধান উপদেষ্টাকে ফখরুল
১৬ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:২৭ | আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ ২২:৪৫
যমুনায় বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ছবি: পিআইডি
ঢাকা: অন্তর্বর্তী সরকার ও সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সমর্থনকারী বলে দাবিদার কিছু ব্যক্তির বক্তব্য জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে বলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়ে এসেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বুধবার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৈঠক করতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে এ কথা জানান ফখরুল।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি যে, যেকোনো রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী ও তার সরকারের বক্তব্য ও মতামতে সমন্বয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি এর কিছু ব্যতিক্রম আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে। আমরা আপনাকে সমর্থন জানিয়েছি এবং আপনার ওপরই আস্থা রাখতে চাই। কিন্তু আপনার সরকারের কিছু ব্যক্তি এবং আপনাকে সমর্থনকারী বলে দাবিদার কিছু ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রকাশ্য ব্যক্তব্য ও অবস্থান জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। আশা করি আপনি এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’
তিনি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিটি লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেওয়া গর্বিত অংশীদার হিসেবে বিএনপি তার অবস্থান থেকে প্রতিটি লড়াইয়ের সুফল জনগণের জন্য কার্যকর করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এবং করছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সেই লক্ষ্যে এবারও জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের সুফল জনগণের কল্যাণে এবং তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে নিবেদিত করার টেকসই ক্ষেত্র প্রস্তুতের লক্ষ্যে দেশের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপরিচালনার ভার আপনার ওপর অর্পিত হলে আমরা সমর্থন জানিয়েছি এবং দায়িত্ব পালনে আপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা করছি।’
তিনি বলেন, ‘আপনার নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের স্বাভাবিক প্রত্যাশা ছিল যত দ্রুত সম্ভব ফ্যাসীবাদী দল ও তার দোসরদের আইনের আওতায় এনে তাদের গণবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, দূর্নীতি-অনাচারের মাধ্যমে দেশের সম্পদ লুণ্ঠুণকারীদের বিচার ও পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার, ফ্যাসিস্ট সরকারের হাতে নিহত ও আহদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপুরণ, সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং দ্রব্যমূল্য ও আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পতিত সরকারের সব অপচক্র ও সিন্ডিকেট ধ্বংস করার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা জানি যে, পতিত ফ্যাসীবাদী সরকার দেশের সংবিধান, আইন, বিধি, প্রতিষ্ঠান এমনকি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের এমনভাবে কলুষিত করেছে যে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনেক বিষয়েই পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন অনিবার্য। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগের প্রতি আমরা সমর্থন জনিয়েছি-সহযোগিতা করছি।’
তিনি আরও বলেন, “বিএনপি মনে করে যে, জনগণের স্বার্থরক্ষা ও স্থায়ী কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য গণতান্ত্রিক শাসনের বিকল্প নেই। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। পতিত সরকারের ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’ যেমন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের অপকৌশল ছিল, এখনও কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ‘আগে সংস্কার পরে গণতন্ত্র’ তেমনি ভ্রান্ত কুতর্ক।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার মাধ্যমেই সবার জন্য উন্নয়ন সম্ভব এবং এ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইন, নীতি, বিধানের সংস্কার অপরিহার্য। এর সবগুলো পরস্পরের পরিপূরক, কোনোটাই কোনোটার বিকল্প নয়; পরস্পর সাংঘর্ষিকও নয়।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির ইতিহাসে প্রায় সব যুগান্তকারী সংস্কার বিএনপির হাত ধরেই এসেছে। যখন এদেশের কোনো রাজনৈতিক দল সংস্কারের বিষয়ে কোনো কথা বলেনি তখনও রাষ্ট্রপতি জিয়উর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণে ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্ব এবং ২০১৭ সালের ১০ মে খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০, ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর তারেক রহমানের রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা এবং আন্দোলনরত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা উল্লেখযোগ্য।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজ যারা সংস্কারের কথা বেশি বেশি বলে এবং বিএনপিকে সংস্কারের বিপক্ষের শক্তি বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করছে তাদের ভিশন-২০৩০ এবং রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা কর্মসূচিতে যেসব সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে ও যেসব পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়েছে, তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
তিনি বলেন, ‘গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ এবং ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ আমরা আপনাকে লিখিতভাবে আমাদের কিছু উদ্বেগের কথা এবং কিছু পরামর্শ জানিয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সেসব বিষয় আপনাদের অবস্থান আমরা জানতে পারিনি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকারের দ্বারা বৈষম্যের শিকার ও পদোন্নতি বঞ্চিত প্রশাসন ক্যাডারের ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে সচিবসহ বিভিন্ন পদে ভুতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হলেও তাদের একজনকেও এখন পর্যন্ত পদায়ন না করে পতিত সরকারের অপশাসনের দোসর ও সুবিধাভোগীদের দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করার ফলে সরকারের কার্যক্রম ও উন্নয়ন প্রয়াস ব্যহত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের জনগণকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার যে মহান দায়িত্ব আপনার ওপর অর্পিত হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব আপনি তা পালন করবেন। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব আইন, বিধি-বিধান সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব পরিবর্তন জরুরি তা সম্পন্ন করার মাধ্যমে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব বলে আমরা মনে করি।’
পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া, এনআইডি প্রকল্প নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখা এবং নির্বাচনি এলাকা পুননির্ধারণে আইনি জটিলতা দ্রুত নিরসনেরও প্রস্তাব দেন তিনি।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম