আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারের অগ্রগতি নিয়ে শঙ্কায় শহিদ পরিবার
১৮ এপ্রিল ২০২৫ ১৯:৫০ | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:১৭
ঢাকা: ছাত্র-জনতার তাজা রক্তে ৫ আগস্ট আকাশে উদিত হয় নতুন এক সূর্য। নতুন স্বাধীনতার স্বাদ পান দেশের মানুষ। কিন্তু আট মাস পেরিয়ে গেলেও জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারের অগ্রগতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ধরাছোঁয়ার বাইরে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানোর ইন্ধনদাতারাও। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগের রাঘববোয়ালরা। এ নিয়ে শঙ্কায় শহিদ-আহতদের পরিবার। তবে বিচারকাজ ঠিকঠাক গতিতেই চলছে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর দফতরের তথ্যমতে, ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত ৩৩৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। তদন্ত চলছে ৩৯টির। ২২টি হয়েছে আনুষ্ঠানিক মামলা। এর মধ্যে চলতি বছরে হয়েছে ১৫টি ও সাতটি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী। এসব মামলা তদন্তে এক হাজারেরও বেশি ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়েছে। জবানবন্দি দিয়েছেন হাজারেরও অধিক মানুষ।
এছাড়া ২২টি মামলার বিপরীতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে ১৪১ জনের নামে। পরোয়ানা জারির পর গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন ৫৪ জন। আর ৮৭ জন এখনও পলাতক। ১৪১ জনের বিরুদ্ধেই গণহত্যায় জড়িত থাকার প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। এর মধ্যে বেসামরিক ৭০ জন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ৯ জন ও পুলিশ-র্যাব তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৬২ জন।
তদন্তের শেষ পর্যায়ে চারটি মামলা। এর মধ্যে রয়েছে আশুলিয়ায় ছয় তরুণের লাশ পোড়ানোর মামলা, রাজধানীর চানখারপুলে আনাসসহ সাতজনকে হত্যার ঘটনা, রামপুরার মেরাদিয়া এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকা কিশোরসহ তিনজনকে গুলি করা মামলা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হওয়া মামলার তদন্ত প্রতিবেদন। দুই মামলার চূড়ান্ত অভিযোগপত্র চলতি মাসেই ট্রাইব্যুনালে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
তথ্য বলছে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে সংঘটিত ঘটনায় দেশজুড়ে মামলা হয়েছে ১৪৯৯টি। এসব মামলায় হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হামলা-ভাঙচুরসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯৯টি রয়েছে হত্যা মামলা; যার ৬০ শতাংশেরই তদন্ত শেষের দিকে। শুধু ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামেই রয়েছে ৩২৪টি মামলা।
জানা গেছে, তিনটি সংস্থার সমন্বয়ে চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম। বর্তমানে তদন্ত সংস্থায় কর্মকর্তা রয়েছেন ২৪ জন। এর মধ্যে সাম্প্রতিক নিয়োগ পেয়েছেন সাতজন। বাকি ১৭ জনই এতদিন কাজ করেছেন। তবে আটজন কর্মকর্তা দিয়ে শুরু হয় তদন্ত সংস্থার কার্যক্রম। সম্প্রতি যুক্ত হওয়া চারজনসহ প্রসিকিউশন টিমে চিফ প্রসিকিউটরসহ রয়েছেন ১৭ জন।
স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়েই জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারকাজ শুরু করা হয় বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধবিষয়ক তদন্তকাজে অভিজ্ঞ লোকের অভাব রয়েছে। ঘাটতি রয়েছে দক্ষ তদন্তকারী কর্মকর্তারও। মূলত ট্রাইব্যুনালে নিয়োগপ্রাপ্তদের আগের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। একেবারে নতুনই বলা চলে। তবে ধীরে ধীরে তারা দক্ষ হয়ে উঠছেন। এজন্য শুরুতে কিছুটা সময় লেগেছে। এরপরও আন্তার্জাতিকভাবে হওয়া বিচারের তুলনায় আমাদের তেমন বেশি সময় লাগেনি ‘
বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধায় নানান ষড়যন্ত্র চলমান জানিয়ে গাজী তামিম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে। এমনকি তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রসিকিউশন টিমের ওপর বোমা হামলার চেষ্টা চালানো হয়। এছাড়া বিপুল অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কার্যক্রমকে বাধার চেষ্টা করছেন পলাতক সুবিধাভোগীরা। তবে দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়া আসামিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। তবু আইনি ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার শহিদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২৫ হাজার। গত ১৫ বছরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িতরাও রয়েছেন। এসব মামলার তদন্ত করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। এজন্য আমরা তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর জোর দিচ্ছি। আমরা সর্বনিম্ন সময়ের মধ্যেই বিচারকাজ সম্পন্নের চেষ্টা করছি।
এদিকে, গণহত্যাকারীদের বিচার নিয়ে শঙ্কিত শহিদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা শামসি আরা জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভেবেছিলাম অল্প সময়ের মধ্যে খুনিদের বিচার হবে। কিন্তু আট মাস পেরোলেও কার্যত কোনো কিছুই চোখে পড়েনি। এ নিয়ে আমরা চিন্তিত। এছাড়া নির্বাচনের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নির্বাচিত সরকারের আমলে গণহত্যার বিচার না হওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। তাই ড. ইউনূস ক্ষমতায় থেকেই আমাদের সন্তানদের হত্যার বিচার করে যাক। এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।’
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঠিকঠাক গতিতেই ট্রাইব্যুনালের কাজ চলছে। তুলনামূলক তেমন সময় যায়নি। দ্রুতই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এ মাসে শেখ হাসিনাসহ গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মামলার প্রতিবেদন দেবে সংশ্লিষ্ট টিম। সবমিলিয়ে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজে কোনো ধীরগতি নেই।,
পলাতক আসামিদের নিয়ে তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই আসামিদের গ্রেফতার করতে হবে। ঢালাওভাবে গ্রেফতারের কোনো কিছু নেই। আর দেশ থেকে যারা পালিয়েছেন, তাদেরও আইনি প্রক্রিয়ায় ফেরানোর চেষ্টা চলছে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায় চূড়ান্ত নয়। আপিলের সুযোগও থাকবে।’
নির্বাচিত সরকার এলে বিচার না হওয়ার শঙ্কা প্রসঙ্গে এই আইনজীবী বলেন, ‘আইন সবসময় নিজের গতিতেই চলে। সরকারের ওপর বর্তায় না। তবে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে হওয়া এসব মামলার তথা গণহত্যাকারীদের বিচার যেকোনো সরকারই করবে বলে মনে করেন তিনি।
সারাবাংলা/আরএম/এসআর