টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
বাক্সবন্দি পড়ে আছে যন্ত্রপাতি, সেবাবঞ্চিত ৪০ লাখ মানুষ
১৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:১২
টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। বহু প্রতীক্ষিত সে দাবি পূরণও হয়েছে। তবে অপরিকল্পিত অবকাঠামো, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ লোকবলের অভাব, বাক্সবন্দি যন্ত্রপাতি এবং আউটডোর পুরো চালু না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার ৪০ লাখ মানুষ। সেই সঙ্গে অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটাসহ নানা ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে হ য ব র ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালে ১৫ তলা হাসপাতালের ভবন বুঝিয়ে দেয় গণপূর্ত বিভাগ। পর্যায়ক্রমে যন্ত্রপাতি কেনা, ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ লোকবলও নিয়োগ হয়। এর আগে ২০২১ সালে স্বল্প পরিসরে চিকিৎসাসেবা চালু হয়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না জেলার ৪০ লাখ মানুষ।
সম্প্রতি সরেজমিনে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখা যায়, মেডিসিন বিভাগে তিনটি ইউনিটে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। জনবল সংকটের কারণে অর্থোপেডিক, নাক-কান-গলা, চক্ষু এবং নবজাতক শিশু বিভাগ, ও ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন বিভাগে পুরোপুরি সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ নেই। ডায়ালাইসিস মেশিন বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে। ফলে চিকিৎসা পাচ্ছেন না কিডনি রোগীরা। এনেসথেসিয়া না থাকায় আইসিইউ ভেন্টিলেটর মেশিন চালু করা যাচ্ছে না। জনবলের অভাবে আলট্রাক্লিন অপারেটিং থিয়েটার চালু করা যায়নি। কোটি টাকা দামের দু’টি এক্সরে মেশিনও বাক্সবন্দি পড়ে আছে। লাখ টাকা দামের ডেন্টাল চেয়ার রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। জরুরি রোগীর জন্য অ্যাম্বুলেন্স সেবা চালু নেই। যত্রতত্র মায়লা আবর্জনা। ওয়ার্ডে ডাক্তারদের বসার কক্ষ নেই। নেই রান্নার ব্যবস্থা। রোগীর খাবার সরবরাহ হচ্ছে জেনারেল হাসপাতাল থেকে। হাসপাতালের জন্য মোট জনবল প্রয়োজন ৩৩২ জন। সেখানে এখনো শূন্য পদ ১৬২টি।
সংশ্লিষ্ঠ সূত্র জানায়, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকেই আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতারা এটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। প্রকল্প কর্মকর্তা ও পরিচালকের সঙ্গে যোগসাজশে চলে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি। হাসপাতালের ১৫ তলা ভবনের কাজ বাগিয়ে নেয় তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের মামাতো ভাইয়ের নুরানী কন্সট্রাকশন। ১২ তলার নকশার অনুমোদন হলেও পরে তা ১৬ তলায় রূপান্তারিত হয়। আর প্রশাসনিকসহ সকল ভবনের কাজ ভাগবাটোয়ারা করে নেয় প্রভাবশালী নেতারা। এছাড়া, যন্ত্রপাতি ক্রয়, জনবল নিয়োগ এবং ওষুধ-চিকিৎসা সরঞ্জামের টেন্ডারে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
শুরুতে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আলী মিয়া। তার তত্ত্বাবধানে প্রকল্পের কাজ ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটার টেন্ডার হয়। প্রকল্প পরিচালক ও মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নুরুল আমীন মিয়া যন্ত্রপাতি গ্রহণ করেন। তবে ক্রয়নীতি উপেক্ষা করে পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি কেনা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এদিকে ১২টি ডায়ালাইসিস মেশিন কে গ্রহণ করেছিল তার সটিক তথ্য নেই কতৃপক্ষের কাছে। হাসপাতালের লিফটগুলো চলন্ত অবস্থায় কাঁপতে থাকে। ১২টি লিফটের বেশির ভাগই মাসের পর মাস অচল থাকে। জার্মানিতে প্রি-শিপমেন্ট ভিজিটে অধ্যক্ষ একজন কিউরেটরকে পাঠান। এছাড়া, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হাসপাতালের আর্থিক খাতে রয়েছে দুই কোটি ৮৩ লাখ টাকার অডিট আপত্তি।
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে সাবেক পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আলী মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘১৫ তলা ভবনের ডিজাইন অনুমোদন করা হয় সংশ্লিষ্ট প্ল্যানিং শাখা থেকে। যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে নিয়ম মেনে।’ অপরদিকে কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নুরুল আমীন জানান, তিনি ২৭ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনেন। আর ৬৯ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছেন মোহাম্মদ আলী মিয়া। ড্যাবের টাঙ্গাইল জেলার আহবায়ক ডা. আব্দুল মতিন জানান, দায়িত্বপ্রাপ্তরা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। সেবার মানসিকতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করেননি। টাঙ্গাইল গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শম্ভু রাম পাল সারাবাংলাকে জানান, অবকাঠামো তেমন ত্রুটি নেই। প্রকল্পে অবকাঠামোর প্রাপ্ত বরাদ্দ ছিল ৩৬৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ব্যায় হয়েছে ৩৫৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। প্রকল্প থেকে সাশ্রয় হয়েছে ২৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল সারাবাংলাকে জানান, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় বর্তমানে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ নামকরণ করে সেবার পরিবর্তে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল। বিগত ১৬ বছরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সদ্য প্রয়াত ফজলুর রহমান খান ফারুক, টাঙ্গাইল-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জোহারুল ইসলাম জোয়াহের ও টাঙ্গাইল সদরের সাবেক সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন হাসপাতালের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে যোগসাজসে অবকাঠামো নির্মাণ, ওষুধ ও সরঞ্জামসংক্রান্ত টেন্ডার, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
বর্তমান সরকাররের কাছে আমাদের প্রত্যাশা এ বিষয়ে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সেই সঙ্গে হাসপাতাটির সেবার মান আরও কীভাবে বাড়ানো যায় সে নিকে নজর দেওয়ার দাবি জানান বিএনপির এই নেতা।
টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুস সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুরুতে টাঙ্গাইল মেডিকেল হাসপাতাল প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলে সাবেক পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আলী মিয়া। উনার তত্ত্বাবধানে এ প্রকল্পের কাজ হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক ও কলেজের অধ্যক্ষ ডা. নুরুল আমীন মিয়া এ প্রকল্পের সব যন্ত্রপাতি গ্রহণ করেছিলেন। তবে যন্ত্রপাতিগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই ভবনে ১২টি লিফট থাকলেও তার মান খুবই নিম্নমানের। সচলের চেয়ে অচলই থাকে প্রায় সময়।’
তিনি আরও জানান, প্রকল্পের অনিয়মের মধ্যে একটি হলো- ১০টি ডায়ালাইসিস মেশিন চালু করা। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো- সে সময় কে ডায়ালাইসিস মেশিনগুলো গ্রহণ করেছিলেন এর সঠিক কোনো তথ্য নেই। জনবল সংকটের কারণে এখন পর্যন্ত অর্থোপেডিক্স, নাক-কান-গলা, চক্ষু ও আইসিইউ এবং ডায়ালাইসিসি বিভাগ চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ডাক্তার ও নার্সের চাহিদা পূরণ হলে পুরোপুরি স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
সারাবাংলা/পিটিএম