দুর্গম হাওরের অস্থায়ী বসতি ‘খলাবাড়ি’
২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:০৪
সুনামগঞ্জ: দুর্গম হাওরে বোর চাষাবাদের সুবিধায় মৌসুমি বসতি গড়েন বর্গাচাষিরা। যেখানে বর্ষায় বিশাল জলরাশির ঢেউ ওঠে, সেখানে শুষ্ক মৌসুমে হয় চাষিদের অস্থায়ী ঠিকানা। এসব বসতির একেক অঞ্চলে একেক নামে পরিচিত। কোথাও ‘জিরাতি’ আবার কোথাও ‘খলাবাড়ি’।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নে দেখার হাওরে শতবছর আগে ‘খলাবাড়ি’ গড়ে ওঠেছিল। বিশাল হাওরের মাঝখানে গড়ে ওঠা খলাবাড়িতে সংগ্রামী জীবন চাষিদের।
খড়-বাঁশে তৈরি বসতিতে বছরের সাত থেকে আট মাস ঠাঁই নেন কিছু পরিবার। ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাত তাদের নিত্যসঙ্গী। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয় এসব কৃষক পরিবারকে।
হাওরের ‘খলাবাড়ি’তে রয়েছে ‘খলা’ (ধান শুকোনোর উঠান)। সেখানে হাওরে উৎপাদিত ধান মাড়াই ও শুকানো হয়। এরপর ‘খলা’ থেকে গোলায় উঠে উৎপাদিত ফসল।
খলাবাড়ি চারপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। এ যেন ফসলের খনি। চাল-ডাল, শাক-সবজি, মাছ, এমনকি রান্নার উপকরণ খড়-লাকড়ি সবই খলাবাড়ির বাসিন্দাদের উৎপাদিত। তাদের বাড়ির আঙিনায় উৎপাদিত নানান শাক-সবজি তাদের খাদ্যের যোগান।
সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের দেখার হাওরে এই ‘খলাবাড়ির’ অবস্থান। প্রতি বছর জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন কয়েকটি পরিবার। কেউ কেউ বংশ পরস্পরায় এখানে এসে বর্গাচাষ করছেন। প্রতি বিঘা জমিতে চার থেকে পাঁচ মণ ধান দেন জমির মালিককে। ঘরের পুরুষ সদস্য এই সময়ে বোরো ধান রোপন, রক্ষণাবেক্ষণ, কর্তন, শুকানোর কাজে যুক্ত থাকেন। মহিলা সদস্যরা বাড়ির আঙিনায় শাক-সবজির আবাদ, গবাদিপশু পালন, রান্না-বান্নার কাজ, গরুর গোবর থেকে মুট্টিয়া (জ্বালানি) তৈরি করেন। এভাবেই হাওরের অস্থায়ী বসতি স্থাপনকারীদের ৭-৮ মাস কেটে যায়। বৈশাখে নতুন ধান উঠিয়ে বাড়ি ফিরেন তারা। যুগের পর যুগ ধরে হাওরে ফসল আবাদের সঙ্গে যুক্ত এসব পরিবার।
দোয়ারাবাজার উপজেলার পান্ডারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা স্মৃতি রঞ্জন দাস। কার্তিক মাসে পরিবার নিয়ে হাওরের পতিত জমিতে বাঁশ-খড় দিয়ে মাটির ঘর বানিয়ে বসবাস করছেন। এবার তিনি ১৪ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। তিনটি টি গরু পালন করছেন। শাক-সবজি সব নিজেরাই আবাদ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এখানে বছরের প্রায় ৮ মাস থাকি আমরা। আমার দাদা এখানে আসতেন, পরে বাবা। বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় এসেছি। এখন সঙ্গে আসছে আমার সন্তানরাও। প্রতি বছরই বোরো ধান আবাদ করি। বৈশাখে খলায় ধান শুকিয়ে বাড়ি যাই।’
একই উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের বাসিন্দা জবর আলী বললেন, ‘কুঁড়ে ঘর বানাতে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা খরচ হয়। জৈষ্ঠ মাসে যাওয়ার সময় ঘর ভেঙে বাড়ি নিয়ে যাবো। এখানে থেকে জমিতে চাষাবাদ করি। গরু পালন করি।’
একই উপজেলার পান্ডারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা সীমা রানী দাস বললেন, ‘হাওরের মাঝে খলায় ঘর বানিয়ে থাকি। রাস্তাঘাট না থাকায় বাজারে যেতে অসুবিধা হয়। ঘরের পেছনে লাউ, সীম, বেগুণ, মরিচ আবাদ করেছি। আসার সময় গেল বছরে পাওয়া ধান—চাল নিয়ে এসেছি। রান্নার জন্য গোবর থেকে মুট্টিয়া (জ্বালানি) তৈরি করি। তেল আর সাবান ছাড়া এখানে এসে কিছুই কেনা লাগে না। সবকিছু নিজেরাই উৎপাদন করি।’
একই এলাকার দ্বিপালী রানী দাস বললেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছে ৩৫ বছর আগে। এরপর থেকে প্রতি বছর এখানে আসছি। আমার স্বামী ছোটবেলা থেকে তার বাবার সঙ্গে এখানে আসে। ঝড়-তুফানের দিনে মাঝে মাঝে ডর (ভয়) লাগে। তবুও থাকতে হয়। এই কয়েকমাস থাকলে বছরের খাবার হয়ে যায়। যে ধান পাওয়া যায় খাবার ধান রেখে বিক্রি করে অন্য খরচও চলে।’
তিনি বলেন, ‘এখানে বিদ্যুৎ নেই, সন্ধ্যা হলে কুপি বাতি জ্বালাই। এভাবেই বছরের ৮ মাস কেটে যায় আমাদের।’
এখানকার বাসিন্দাদের সকলেই বিশুদ্ধ পানির সমস্যার কথা জানিয়ে বললেন, খাবার পানির অভাবে তাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়।
মোল্লাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নুরুল হক বললেন, বিভিন্ন উপজেলা থেকে ৩০টি পরিবার এখানে আসে। এদের বেশিরভাগ হলেন বর্গাচাষি। জমির উৎপাদিত ফসলের একটা অংশ মালিককে দেন তারা। হাওয়ের পাঁচ কিলোমিটার গভীরে খলাবাড়িতে তাদের বসবসা। বসবাসকারীদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট যাতায়াতে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক মোস্তফা ইকবাল আজাদ বলেন, ‘বর্গাচাষিরা সরাসরি ফসল বিক্রির সুযোগ কম পান। তাদের লাভ যাতে হয় তার জন্য আমরা কাজ করছি। আমরা তাদের মধ্যে বীজ ও সার সহায়তা দিয়ে থাকি। তবে কাঠামোগত সমস্যার কারণে তারা প্রকৃত লাভবান হতে পারেন না। এ ছাড়াও আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করছি।’
সারাবাংলা/এসআর