‘আয়নাঘর’ নাম শুনলেই গা শিউরে ওঠে সবার। এটি অত্যন্ত বীভৎস গোপন বন্দিশালা। যেখানে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আদর্শ ও ব্যক্তিগত এবং ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী নির্দোষ মানুষদের ওপর অত্যাচার করা হতো। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ এই বন্দিশালা তৈরি করেছিল বলে গুম কমিশনের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। ‘আয়নাঘর’ নামটির সঙ্গে বাস্তব পরিবেশেরও মিল রয়েছে। মানুষ যেমন আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়, তেমনি আয়নাঘরেও নিজেকে ছাড়া বন্দিরা আর কিছুই দেখতে পেত না।সেখানে কেউ বছরের পর বছর, আবার কেউবা দশকেরও বেশি সময় পার করেছেন।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী। তার বাবা গোলাম আযম জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয় ব্রি. জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে। এর পর হঠাৎ একদিন রাতের আঁধারে বাসা থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গুম করা হয়। রাখা হয় আয়না ঘরে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আট বছরের বেশি সময় পরে বিশেষ ওই বন্দিশালা থেকে মুক্তি পান আবদুল্লাহিল আমান আযমী। প্রায় আট বছর আয়না ঘরে কাটিয়েছেন তিনি। সেই আয়না ঘরে কাটানো দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা সারাবাংলার স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মেহেদী হাসানকে বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ব্রি. জেনারেল আযমী।
সারাবাংলা: আয়না ঘরে নির্যাতন, আতঙ্ক ও সেখানকার পরিবেশ কেমন ছিল?
আবদুল্লাহিল আমান আযমী: আমি গেল আট বছর বন্দি থাকা অবস্থায় পৃথিবীর কোনো আলো দেখিনি। প্রতি রাতেই ক্রসফায়ারের ভয় থাকতো। তারা খুব দুর্ব্যবহার করতো আমার সঙ্গে। আমি তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে শুধু কান্না করতাম। আমার লাশটা যেন পরিবারের কাছে যায়।
সারাবাংলা: ঈদের সময় কি বুঝতে পারতেন যে আজ ঈদ?
আবদুল্লাহিল আমান আযমী: ঈদুল ফিতর এলে তারা সাধারণত আমাকে জানাত। কিন্তু কোরবানির ঈদ অর্থাৎ ঈদুল আজহার কথা তারা জানাত না। তবে আমি রোজার ঈদ থেকে দিন হিসেব করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ, কোরবানির ঈদের আগে আমি আরাফার রোজা রাখতাম।
সারাবাংলা: রমজান মাস এলে আয়না ঘরে আপনিসহ আরও যারা বন্দি ছিলেন তাদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হতো?
আবদুল্লাহিল আমান আযমী: রোজার সময় অন্যদের সঙ্গে কীরকম আচরণ করা হয়েছে বা হতো সেটি আমি দেখতে পারিনি। কারণ, যারা বন্দি ছিলাম তারা যে যার রুমে থাকতো। সেখানেই বন্দি অবস্থায় দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে। আর এই অবস্থায় অন্যদের খোঁজ নেওয়া সম্ভব ছিল না। রমজান মাস এলে যারা দায়িত্বে থাকতো তারা আমাকে জানাত যে, রোজা শুরু হয়েছে। সেভাবেই আমি রোজা রাখতাম। আর রোজার সময় খাবারে পরিবর্তন ছিল না, অন্য সময়ে যে ধরনের খাবার দিত, ঠিক সেরকমই খাবার দিয়েছে। তবে আমি যে সময়টাতে সেহরি দিতে বলতাম, সেই সময়টাতেই তারা দিত।
সারাবাংলা: নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার বিচার শেষ করা দরকার কি?
আবদুল্লাহিল আমান আযমী: তার বিচার দ্রুততম সময়ে হওয়া দরকার বলে মনে করি। তিনি যেরকম অন্যায়ভাবে গণহত্যা চালিয়েছে, অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে, পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে, মানুষকে গুম করে বন্দি রেখেছে, সেসব ঘটনার বিচার হওয়ার দরকার।
সারাবাংলা: আওয়ামী লীগ সরকারের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আপনার কোনো কিছু বলার আছে কি?
আবদুল্লাহিল আমান আযমী: ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য স্বৈরাচার হাসিনা সরকার ট্রাইব্যুনাল তৈরি করেছিল। সেই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে তারা নিজেদের মতো করে অন্যায়ভাবে বিচার কাজ চালিয়েছে। সেসবের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার আগে হওয়া উচিত। আমার বাবা দোষী প্রমাণিত না হওয়ার পরও তাকে ট্রাইবুনালের মাধ্যমে ৯০ বছরের সাজা দেওয়া দিয়েছিল।
সারাবাংলা: দেশে নির্বাচন দেওয়ার সময় এসেছে কি না? নির্বাচনের আগে সংস্কারে কতটা সময় দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আবদুল্লাহিল আমান আযমী: অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কারের জন্য একটা যৌক্তিক সময় দেওয়া প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই যৌক্তিক সময়টা আসলে কত, সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে আমার মতে এই সরকারকে অন্তত দুই বছর সময় দেওয়া দরকার।
উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। তোপের মুখে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতের দিল্লিতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করছেন তিনি।
এদিকে, গণহত্যার অভিযোগ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণহত্যাসহ কয়েক শতাধিক হত্যা মামলার আসামি তিনি।