Friday 02 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

১৫ বছরের সাংবাদিকতা মূল্যায়নে জাতিসংঘে যাবে বাংলাদেশ: প্রেস সচিব

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২ মে ২০২৫ ১৬:৪২ | আপডেট: ২ মে ২০২৫ ১৯:৩৪

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম

চট্টগ্রাম ব্যুরো: আওয়ামী লীগের আমলে ১৫ বছর বাংলাদেশের সাংবাদিতা মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

শুক্রবার (২ মে) সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের জুলাই বিপ্লব স্মৃতি হলে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় শফিকুল আলম এ কথা জানান। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন যৌথভাবে ‘জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশ: গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।

বিজ্ঞাপন

প্রধান অতিথির বক্তব্যে শফিকুল আলম বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের আগে গত ১৫ বছর বড় বড় ঘটনায় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কেমন ছিল, তিনটি নির্বাচনের সময়, মাওলানা সাঈদীর রায়ের পর কিংবা আইসিটি ট্রাইব্যুনালে ছয়জনকে যে ফাঁসি দেওয়া হল, তখন সাংবাদিকরা কিভাবে সাংবাদিকতা করেছেন, আমরা চিন্তা করছি, আমরা জাতিসংঘের কাছে যাব। আমরা জাতিসংঘকে বলব যে, তারা যেন একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্যানেল করে একটা অ্যাসাসমেন্ট রিপোর্ট যেন প্রকাশ করে। আমাদের সাংবাদিকতা যে ফেল করেছিল, এটা দেশ-বিদেশের সবাইকে জানাতে হবে।’

চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের কেউ কেউ আন্দোলনকারীদের ধরিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাবার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই চট্টগ্রামেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা এসে বলছে আন্দোলনের সময় তাদের ধরিয়ে দিয়েছে সাংবাদিক। কী ভয়াবহ অভিযোগ! আমার মনে হয় এসব বিষয়ে প্রেসক্লাবের একটা তদন্ত কমিটি করা উচিত। কোন কোন সাংবাদিক এটাতে ইনভলব ছিল, সেটা এনকোয়ারি করে বের করা উচিত।’

‘চট্টগ্রামে যদি কোনো রিটায়ার্ড জাজ থাকে, তার নেতৃত্বে কমিটি করে দেওয়া উচিত যে কোন কোন সাংবাদিক এতে ইনভলব ছিল। এটা কিন্তু ভয়াবহ অভিযোগ। এটা নিয়ে বসে থাকা যাবে না, যারা যারা এটা করেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। যদি জুলাই আন্দোলন ব্যর্থ হতো, তাহলে ছাত্রদের এই সাংবাদিকরা কী করত একবার ভেবে দেখেন।’

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘যারা স্বৈরাচারের দোসর ছিল, তাদের বিষয়ে অনেকে সফট। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে যে আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। চট্টগ্রামে যে ভয়াবহ অভিযোগ আসল, এটা তো আপনাদের আরও অনেক আগেই ইনভেস্টিগেট করা উচিত ছিল, একটা কমিটি করে দেওয়া উচিত ছিল, হাইকোর্টের একজন রিটায়ার্ড জাজ বা একজন রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জাজ কিংবা একজন ফরমার পুলিশ অফিসারকে দিয়ে দুই-তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দেওয়া দরকার ছিল, এটা কিন্তু অনেক বড় রকমের অভিযোগ।’

গত ১৫ বছর সাংবাদিকদের কেউ কেউ খুন-গুমের বয়ান তৈরি করেছে মন্তব্য করে শফিকুল আলম বলেন, ‘যারা দোসর, তারা বয়ান দিয়েছে, চুরির বয়ান, খুনের বয়ান, গুমের বয়ান। আপনাদের মনে আছে কিনা, একটা গুমের ঘটনা ঘটেছে, অনেক সাংবাদিক সেটাকে জাস্টিফাই করেছে, একটা এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং হয়েছে, অনেক সাংবাদিক সেটাকে জাস্টিফাই করেছে, বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, অনেক সাংবাদিক সেটাকে জাস্টিফাই করেছে যে, ওরা দাঁড়াতে পারে না। কেউ দাঁড়াতে পারে না বলে কি আপনি তাকে অ্যারেস্ট করবেন? এভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বয়ান তৈরি করা হতো।’

‘আপনারা এখানে এতগুলো লোক, একটা লোককে গুম করা হলে, সবাই সাইলেন্ট হয়ে যাবে। গুম করার মানে হল ভয়ের চাদর দিয়ে সোসাইটিকে আটকে রাখা। একটা এক্সট্রা কিলিং জুডিশিয়াল কিলিং হওয়া মানে আর কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। তাহলে এই যে গুম, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং, এগুলোর জন্য বয়ান তৈরি করেছে কারা? সাংবাদিকরা।’

জুলাই পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতা এখন স্বাধীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আট আগস্ট ইন্টেরিম সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পরে বাংলাদেশে এর চেয়ে বেশি ফ্রিডম অব স্পিচের সময় আর আসেনি। ইতিহাসে বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিক এর চেয়ে বেশি ফ্রিডম এনজয় করেছে কিনা আমার সন্দেহ। রাতের বেলা দেখেন, ডজন ডজন বক্তা অনেক কথা বলছেন, অনেকে মিথ্যা কথাও তো বলেন। আমরা কারও মুখ বন্ধ করি না। অনেকে মিথ্যা নিউজ ছড়ান। আমরা গিয়ে তার ফেসবুকের অ্যাকাউন্টটা বন্ধ করি না। অনেকে আজেবাজে কথা বলেন, অনেকে মিথ্যা নিউজ শেয়ার করেন। কেউ কি শুনেছেন আমরা তার বিরুদ্ধে লেগেছি, তার ফ্রিডমটাকে কার্টল করেছি, অথচ আমাদের যথেষ্ঠ সুযোগ ছিল এগুলো বন্ধ করার।’

‘২০১৮ সালে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করার সময় উনারা বলেছিলেন যে ডিজিটাল স্পেসটাকে নিরাপদ রাখার জন্য আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। কিন্তু তারা এই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করে পুরো বাংলাদেশের মুখটা বন্ধ করতে চেয়েছে। আমরা এসে নতুন একটা আইন করছি। আপনারা নিশ্চিত থাকেন, এই আইনে আপনাদের অধিকারটা সুরক্ষিত থাকবে। একইসময়ে ভারনারেবল গোষ্ঠী, তাকে যেন আমরা প্রটেকশন দিতে পারি, সেই বন্দোবস্তও থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে এখন আমি তো বলব, যার যা ইচ্ছে তা-ই লিখতে পারে। সবার রাইটসটাকে আমরা প্রটেক্ট করছি। দুয়েকটা ঘটনা ঘটছে, সত্যি কথা হলো এসব ঘটনার পেছনে সরকার অনুঘটক না। সরকার বলছে না যে একে তুমি রিপ্লেস কর, একে সরিয়ে ওকে নাও কিংবা এই লোকটা দোসর ছিল, তাকে সরিয়ে একে নাও।’

‘আমরা জুলাইয়ের আগে গত ১৫ বছর ধরে সাংবাদিকদের যেসব বয়ান দেখেছি, অন্যান্য দেশ হলে বিপ্লবের পর এসব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হতো, টিভিগুলো বন্ধ করে দেওয়া হতো। টিভিগুলোতে আপনারা দেখেননি অপজিশন লিডারকে কীভাবে মকিং করা হয়েছে। তারা কীভাবে গুমের বয়ান তৈরি করেছে, গুমটাকে জাস্টিফাই করেছে, এর চেয়ে ভয়ানক ক্রাইম পৃথিবীতে নেই।’

তিনি বলেন, ‘যারা সত্যিকার অর্থে জার্নালিজম করছেন, আমি বলব, এর চেয়ে বেটার টাইম আর আসেনি। আমরা কারও মুখ বন্ধ করছি না, কারও কলম ভেঙ্গে ফেলছি না, আমরা কারও প্রেস সিলগালা করছি না। আমরা বলছি, আপনারা জার্নালিজম করেন। প্রফেসর ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম মাসেই এডিটরদের ডেকেছিলেন, আপনাদের চট্টগ্রামের দুজন এডিটরও গিয়েছিলেন। ডেকে বলেছিলেন, আপনারা মন খুলে লেখেন, আমরা চাই সবাই মন খুলে লেখেন, আমার ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আপনার, আপনি আমাকে বলেন যে, আপনার এ কাজটা ঠিক হচ্ছে না বা আপনার এই পলিসিটা ঠিক হচ্ছে না। আমরা সেই জার্নালিজম দেখতে চাই।’

‘কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেকে বলছেন আগের চেয়েও খারাপ অবস্থা, তিনজন সাংবাদিকের চাকরি চলে গেছে। তিনজন সাংবাদিকের চাকরি তো আমরা খাইনি। আপনারা যারা সাংবাদিকতা করছেন, আপনারা ওই তিন টিভি স্টেশনের সামনে গিয়ে প্রোটেস্ট করেন। আমরা কোনো সাংবাদিকের চাকরি খাচ্ছিও না, কাউকে জব দিচ্ছিও না। আপনারা যদি প্রোটেস্ট করা উচিত মনে করেন, আপনারা গিয়ে প্রোটেস্ট করেন। আপনারা যদি মনে করেন, সরকার ভেতরে ভেতরে এ ঘটনাগুলোর পেছনে চাল চেলেছে। তাহলে আপনারা তদন্ত করে দেখেন আমরা চাল চেলেছি কি না, সরকারের কোনো রোল আছে কিনা আপনারা দেখেন।’

শফিকুল আলম বলেন, ‘ফ্রিডম অব স্পিচকে খর্ব করবে, এমন কোনো কাজ ইন্টেরিম সরকার করবে না।
আমরা বাংলাদেশে জার্নালিজমের বিকাশ চাই। বাংলাদেশে জার্নালিজম খুব ক্রান্তিলগ্নে আছে। মানুষ এখন নিউজপেপার পড়ছে কম, নিউজ দেখছে ভিডিওতে। কিন্তু আপনারা জানেন ভিডিওতে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগটা সবচেয়ে বেশি। আগে অপতথ্য ডোমেস্টিক্যালি ছড়ানো হতো, এখন দেখছি ফরেন মিডিয়াও এতে যুক্ত হয়েছে এবং খুব ভয়াবহভাবে অপতথ্য ছড়াচ্ছে। মানুষ এগুলো আবার বিশ্বাসও করছে, কারণ ভালো ভালো মিডিয়া, ইন্ডিয়ান মিডিয়া, তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বারবার আমাদের নামে অপতথ্য ছড়ানো।

‘জুলাইয়ের পর থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন হয়েছি এই অপতথ্য নিয়ে। দুইটা সোর্স- একটা হচ্ছে ইন্ডিয়ান মিডিয়া, আরেকটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের মিডিয়া। এরা সব এক হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সামনে নির্বাচন। আমাদের গণমাধ্যমকে এগুলোর জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এটি শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়। প্রত্যেকটি পত্রিকার ফ্যাক্ট চেকিং সেল থাকা দরকার। এটি পোস্ট রেভ্যুলেশনারি চ্যালেঞ্জ।’

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচির সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন ও মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী। ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার।

এ ছাড়া বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আব্দুস সাত্তার, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ডা. খুরশীদ জামিল, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ওসমান গণি মনসুর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শহীদুল হক, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নসরুল কদির, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ ও সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান, সাংবাদিক গোলাম মওলা মুরাদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক রিজাউর রহমান, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য নীলা আফরোজ।

সারাবাংলা/আরডি/এইচআই

জাতিসংঘ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর