Monday 05 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রাইভেট-কোচিং: বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের বিমুখতার সঙ্কট

সুদীপ্ত শামীম
৫ মে ২০২৫ ১৫:১২

এক সময় বিদ্যালয় ছিল শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র, শিক্ষার্থী ছিলেন শ্রদ্ধাশীল অনুসারী। পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিক্ষকদের মুখনিঃসৃত জ্ঞানকথাই ছিল শিক্ষার পরিপূর্ণ রূপ। সেই সোনালি সময় এখন যেন কেবল স্মৃতির পাতায় বন্দি। বর্তমানের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজ শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের পাঠের চেয়ে প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারের পাঠকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমেই প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মনে করছেন, ‘প্রতিষ্ঠান’ নয়, ‘প্রস্তুতি’ই মুখ্য। এই প্রবণতা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং একটি সামগ্রিক জাতীয় সংকটের দিকে ইঙ্গিত করছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ—প্রথমত, সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে একটি শ্রেণিতে ৭০-৮০ জন শিক্ষার্থী। স্বাভাবিকভাবেই একজন শিক্ষক সেখানে প্রত্যেককে মনোযোগ দিয়ে পড়াতে পারছেন না। দ্বিতীয়ত, পাঠ্যবইয়ের ভাষা ও উপস্থাপনা এমনভাবে করা হয়েছে, যা অনেক শিক্ষার্থীর কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগ ও অনুশীলনের যথেষ্ট সুযোগ না থাকায় বিদ্যালয়ের পাঠে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে অনেকেই।

বিজ্ঞাপন

তৃতীয়ত, এক শ্রেণির শিক্ষক নিজের কোচিং সেন্টারে বেশি গুরুত্ব দেন। শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ কম, অথচ কোচিংয়ে গেলে বিশেষ যত্নে পড়ানো হয়—এই ‘নিখুঁত হিসাব’ বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই এখন বোঝে। এ যেন অঘোষিত বাধ্যবাধকতা। অনেকে তো খোলাখুলিই বলেন, ‘ভালোভাবে বুঝতে হলে আমার প্রাইভেট ক্লাসে এসো।’ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অব্যবস্থা ও নজরদারির অভাবে।

তবে দায় শুধুই শিক্ষকের নয়, অভিভাবকরাও কম দায়ী নন। তাদের অনেকেই সন্তানকে ভালো ফলাফলের জন্য যেকোনো মূল্যে কোচিংয়ে পাঠাচ্ছেন। বিদ্যালয়ে সন্তান ক্লাস করছে কি না, শিক্ষক নিয়মিত আসছেন কি না—এসব বিষয়ে অধিকাংশ অভিভাবকের কোনো খোঁজখবর থাকে না। পরীক্ষায় এ-প্লাস পেলেই সন্তুষ্ট। তারা জানেন না—এই প্রক্রিয়ায় তাদের সন্তানের ভেতর থেকে সৃজনশীলতা, স্বাধীন চিন্তা ও নৈতিক বোধ একেবারেই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

একটি শিক্ষার্থী যখন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে সকাল ৬টায় প্রাইভেট পড়ে, এরপর বিদ্যালয়ে যায়, দুপুরে আবার কোচিং করে, রাতে আবার আলাদা গৃহশিক্ষক—তখন সে সত্যিকার অর্থে ‘বিদ্যার্জন’ নয়, বরং ‘বিস্মৃতির’ পথে হাঁটে। কারণ সে মুখস্থ করতে করতে নিজের ভাবনার জগৎ হারিয়ে ফেলে। ক্লাসে প্রশ্ন করার প্রবণতা কমে যায়, জবাব না জানলে শিক্ষকের সঙ্গে বিতর্ক করার সাহস হারায়। এমন ছাত্রছাত্রী দিয়ে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন কতটা সম্ভব?

এই সমস্যা শুধু শহরে নয়, গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। এক সময় গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ের খরচ মেটাতে পারতো না। এখন সেখানে ওষুধের দোকান, মুদি দোকান কিংবা ছাপড়া ঘরে গজিয়ে উঠছে ‘কোচিং সেন্টার’। সেখানে স্থানীয় এক-দুইজন কলেজপড়ুয়া ছাত্র বা সদ্য পাস করা শিক্ষার্থী পাঠ দিচ্ছেন। অভিভাবকরা সন্তানের ভালোর জন্য সেসব জায়গায় পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তাতে শিক্ষার মান উন্নত হচ্ছে না, বরং বিকৃতির রূপ নিচ্ছে।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো, বিদ্যালয়গুলোর মূল্যায়ন ব্যবস্থা। এখন বিদ্যালয়গুলো পরীক্ষায় ফলাফলকে প্রধান মানদণ্ড হিসেবে নিচ্ছে। সৃজনশীলতা, অংশগ্রহণ, আচরণগত পরিবর্তন—এসবের কোনো মূল্যায়ন নেই। ফলে শিক্ষকরাও মনে করেন, পরীক্ষায় ভাল ফলাফলই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকতার প্রমাণ। এতে করে পুরো ব্যবস্থাটিই হয়ে পড়ছে ফলাফলনির্ভর ও কৃত্রিম।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

প্রথমত, বিদ্যালয়কে আবারও শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে হবে। এজন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ জরুরি। শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা নতুন পাঠ্যপদ্ধতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। সৃজনশীল প্রশ্নের ব্যাখ্যা ও প্রস্তুতির জন্য শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত অনুশীলনের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়ার উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। শিক্ষা অফিস, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি, এমনকি অভিভাবকরাও বিষয়টি নিয়মিত খতিয়ে দেখবেন। প্রয়োজনে শিক্ষকদের জন্য কার্যকর ‘পারফরমেন্স মূল্যায়ন ব্যবস্থা’ চালু করতে হবে, যেখানে ভালো ক্লাস নেওয়ার জন্য ইনসেনটিভ এবং অবহেলার জন্য শাস্তির বিধান থাকবে।

তৃতীয়ত, অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে—শুধু ভালো ফল নয়, বরং প্রকৃত জ্ঞান ও মূল্যবোধ শেখানোর জন্যই শিক্ষার প্রয়োজন। সন্তান যেন শিখে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে, সেটাই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য। এজন্য বিদ্যালয় ও অভিভাবকদের মাঝে নিয়মিত মতবিনিময় ও পরামর্শ সভার আয়োজন জরুরি।

চতুর্থত, কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউশন নিয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। শিক্ষক যেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে নিজেই প্রাইভেট না পড়ান—এই নীতিটি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে বিকল্প পদ্ধতি চালু করে শিক্ষার্থীদের ‘রিমিডিয়াল ক্লাস’ বিদ্যালয়ের ভেতরেই দিতে হবে।

পঞ্চমত, পাঠ্যবইয়ের উপস্থাপন সহজ ও প্রাসঙ্গিক করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের জীবনের সঙ্গে পাঠ্যবস্তুর সংযোগ খুঁজে পায়, এমন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে হবে। একইসাথে শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা, দেশপ্রেম, সামাজিক সচেতনতা ও মানবিকতা গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।

আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা যেভাবে বিদ্যালয়কে পাশ কাটিয়ে প্রাইভেট-নির্ভরতা গড়ে তুলছি, তাতে এক ধরনের শ্রেণিবৈষম্যও তৈরি হচ্ছে। যারা প্রাইভেট পড়াতে পারছে না, তারা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলোর সন্তানরা ধীরে ধীরে শিক্ষার মূল স্রোত থেকে ছিটকে যাচ্ছে। এই ব্যবধান আগামী দিনে ভয়াবহ সামাজিক সংকট তৈরি করবে।

একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থার উপর। আর সেই শিক্ষাব্যবস্থা যদি হয় শুধুই কোচিং ও প্রাইভেট নির্ভর, তাহলে সেখানে স্বাধীন চিন্তা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তির জায়গা থাকে না। শিক্ষার্থী তখন কেবল নির্দিষ্ট প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর মুখস্থ করতে শিখে—তাকে নতুন কিছু ভাবতে বলা হলে সে থমকে দাঁড়ায়।

এই সংকট সমাধানে এখনই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক কঠোরতা প্রয়োজন। নীতিনির্ধারকদের প্রশ্ন করতে হবে—আমরা কী ধরনের মানুষ তৈরি করতে চাই? কোচিংয়ে বেড়ে ওঠা মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী ছাত্র, নাকি বিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষায় গড়ে ওঠা চিন্তাশীল, মানবিক, সৃজনশীল নাগরিক?

সময় এসেছে আমরা সকলে মিলে শিক্ষার এই গতি থামিয়ে তাকে সঠিক পথে ফেরানোর উদ্যোগ নিই। নইলে একসময় আমাদের হাতে থাকবে অনেক সার্টিফিকেটধারী মানুষ, কিন্তু প্রকৃত মানুষ থাকবে না।

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

বিদ্যালয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের বিমুখতা মুক্তমত সুদীপ্ত শামীম

বিজ্ঞাপন

ইন্দুবালার কচু বাটা
৫ মে ২০২৫ ১৭:১৪

আরো

সম্পর্কিত খবর