ইলিশে ভরপুর গল্প, কিন্তু থালা ফাঁকা!
৫ মে ২০২৫ ১৭:৩৩
ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। ইলিশ সামুদ্রিক মাছ। এরা ডিম পাড়ার জন্য বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীগুলোতে আগমন করে থাকে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইলিশ শুধু বাংলাদেশে নয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসামে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মাছ।
ইলিশ নোনা জলের মাছ। সাধারণত মাছটি বর্ষাকালে পাওয়া যায়। ইলিশ মাছ ডিম পাড়তে সমুদ্র থেকে বড় নদী ও মোহনায় সংযুক্ত খালে আসে। সামুদ্রিক এ মাছটি বড় নদীতে ডিম দেয়। ডিম ফুটে গেলে ও বাচ্চা বড় হলে ইলিশ মাছ সাগরে ফিরতে শুরু করে। ঠিক সাগরে ফিরে যাওয়ার সময় জেলেরা মাছ ধরার নৌকা নিয়ে নদীতে যায় এবং জাল ফেলে মাছ শিকার করে। এই মাছ উপকূলবর্তী ঘাটে আনা হয়। সেখান থেকে বরফ দিয়ে দেশের দূরবর্তী স্থানে পৌঁছানো হয়।
ভোলা জেলার আজুমুদ্দিনে মেঘনা ও বঙ্গপোসাগরের মোহনায় সর্বাধিক পরিমান ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। বলা হয় যে, ভোলা ও চাঁদপুর জেলা ইলিশের জন্য বিখ্যাত। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইলিশ পাওয়া যায় চাঁদপুর জেলায়। ইলিশ উৎপাদনে ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। রপ্তানি করে বাংলাদেশ ইলিশ মাছ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।
বাঙালিদের ইলিশ খুব পছন্দের ও জনপ্রিয় খাবার। ইলিশ একটি চর্বিযুক্ত মাছ আর এতে প্রচুর পরিমানে প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। ইলিশ দিয়ে বিভিন্ন সুস্বাদু পদের রান্না করা যায়। বিশেষ করে সর্ষে ইলিশ, ভাপা ইলিশ, ইলিশ পাতুরি, কড়া ভাজা, দোপেয়াজা এবং ঝোল খুবই জনপ্রিয় খাবার। ডিম ভর্তি ইলিশ মাছ এবং সুগন্ধি চাল দিয়ে বিশেষ এক রকম রান্না করা যায় যা ইলিশ মাছের পোলাও নামে বেশ পরিচিত। এটি বর্ষাকালের একটি বিশেষ রান্না। আবার ইলিশ মাছ টুকরো করে লবনে জারিত করে অনেক দিন সংরক্ষণ করা যায়। এভাবে সংরক্ষিত ইলিশকে নোনা ইলিশ বলা হয়।
পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ আর পান্তা ভাত না হলে যেনো চলেয় না। ইলিশ মাছ নিয়ে রয়েছে আরো অনেক সংস্কৃতি। বিয়ের সময় ইলিশ তাতওয়া উপহার হিসেবে দেয়া হয়। গায়ে হলুদের দিনে বরের পরিবার কনের পরিবারকে একজোড়া ইলিশ উপহার দিয়ে থাকে। আবার অনেক বাঙালি হিন্দু পরিবার বিভিন্ন পূজার শুভ দিনে জোড়া ইলিশ কেনেন। তারা সরস্বতী ও লিক্ষ্মী পূজায় জোড়া ইলিশ কেনা কে শুভ লক্ষণ হিসেবে মনে করেন।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ শুধু একটি সুস্বাদু খাবার নয়, এটি দেশের অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইলিশ মাছ আহরণের সাথে প্রায় ৫ লাখ জেলে পরিবার জড়িত। এছাড়া বিপণন, পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ইলিশ ভিত্তিক অন্যান্য কার্যক্রমে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। প্রতিবছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ ইলিশ উৎপাদন করে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে থাকে।
বাঙালিরা ইলিশ অনেক সময় কিনতে পারেন না। আসলে অনেক সময় বললে হয়তো ভুল হবে, বেশিরভাগ বাঙালি ইলিশ কিনতেই পারেন না। সারা বছরে ইলিশের স্বাদ অনেকে নিতেই পারেন না। ইলিশ মাছের চাহিদা অনেক বেশি, কিন্তু সরবরাহ সীমিত। বিশেষ করে নববর্ষ ও দূর্গাপূজার সময় এর দাম অনেক বেড়ে যায়। সে সময় ওজন ভেদে ইলিশের মাছের দাম হাজার টাকার উপরে চলে যায়, যা অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সামর্থ্যের বাহিরে চলে যায়। বিশেষ করে বিদেশের চাহিদা মেটাতে ইলিশ রপ্তানি করতে হয়। এতে দেশের বাজারে ইলিশের সরবরাহ কমে যায়। এছাড়াও কিছু আসাদু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার অনেক সময় ব্যবসায়ীরা মৌসুমে ইলিশ কিনে ঠান্ডা ঘরে মজুদ রাখেন এবং পরে বেশি দামে বিক্রি করেন। এতে সাধারণ মানুষ মৌসুমেও সস্তায় ইলিশ পায় না।
ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আবেগের প্রতীক। অর্থনীতিতে এর অবদান যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সাধারণ মানুষের খাদ্য তালিকায় এর অবস্থানও অনেক উঁচুতে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজ ইলিশের উচ্চমূল্য ও সংকট সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এর পেছনে রয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়, জাটকা নিধন, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, অপর্যাপ্ত বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানির মুনাফাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি।
এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব, যদি আমরা সমন্বিতভাবে সমস্যার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, জেলে সম্প্রদায় ও ভোক্তা সবার সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমেই টেকসইভাবে ইলিশ সংরক্ষণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব। বাজার ব্যবস্থার সংস্কার, আইন প্রয়োগের দৃঢ়তা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ইলিশকে আবারও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা যেতে পারে। ইলিশ যেন আবার ঘরে ঘরে ফিরে আসে, উৎসব-অনুষ্ঠান বা সাধারণ আহার সব ক্ষেত্রেই যেন এ মাছের স্বাদ উপভোগ করতে পারে প্রতিটি মানুষ, সেটাই হওয়া উচিত আমাদের লক্ষ্য।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এএসজি