Thursday 08 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাবলিক কি খায়!

সুদীপ্ত শামীম
৮ মে ২০২৫ ১৯:০৩

একটা প্রশ্ন এখন প্রায়ই উঠছে– ‘পাবলিক কি খায়?’ আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই দেশের গণমাধ্যম হারিয়ে ফেলছে তার স্বকীয়তা, দায়িত্ববোধ আর সাহস।

প্রথমে টেলিভিশন, তারপর পত্রিকা, এরপর অনলাইন—সবখানেই এখন খবর বাছাই হয় এই মাপকাঠিতে: ‘পাবলিক কি চায়’, ‘ভিউ কিসে আসে’, ‘শেয়ার হবে কোন সংবাদে’। ফলে সংবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা পণ্যের মতো, যার মোড়ক যত চকচকে, বিক্রি ততই বেশি।

গণমাধ্যমের কাজ কি সত্য তুলে ধরা, না কি বাজারের চাহিদা মেটানো? আজ এই প্রশ্নটাই তীব্র হয়ে উঠেছে। যেসব ইস্যু সমাজ পরিবর্তনের জন্য জরুরি– প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রাম, দুর্নীতির রূপরেখা, নীতিহীনতার পেছনের কারিগর, কিংবা চিকিৎসা-শিক্ষা-পরিবেশের ভয়াবহ অবস্থা– সেসব এখন পর্দার আড়ালে চলে যাচ্ছে। কারণ, এগুলোতে ‘রেটিং’ আসে না।

এই যে কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক একটানা সাত দিন ধরে একটি নাটক বা শোবিজ তারকার গসিপ নিয়ে শিরোনাম করল, সেই একই সময় দেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে টানা পাঁচ দিন বিদ্যুৎ ছিল না। কোনো পত্রিকা বা চ্যানেল সেখানে যায়নি, কারণ ওইখানে ‘ভিউ’ নেই। এই যে বৈষম্য, এটাই গণমাধ্যমের নৈতিক পরাজয়।

টকশোতে দেখা যায়, যে যত বেশি চিৎকার করে, যত বেশি নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলে, সে তত বেশি সময় পায়। যারা শান্তভাবে বিশ্লেষণ করতে চায়, সত্য বলার চেষ্টা করে তাদের স্থান সীমিত।

এই চিত্র শুধু নগরভিত্তিক গণমাধ্যমেই নয়, স্থানীয় পর্যায়ের সাংবাদিকতার মাঝেও এখন ঢুকে পড়েছে এই প্রবণতা। সামাজিক মাধ্যমের ভাইরাল কনটেন্টকে খবর বানানো, সত্য যাচাই না করেই হেডলাইন দেওয়া, কিংবা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব– এসবই এখন ‘সাধারণ’ ব্যাপার হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

গণমাধ্যম যদি কেবল ‘পাবলিক কি খায়’ তা দেখেই চলতে থাকে, তাহলে একদিন সে নিজেই অসাড় হয়ে পড়বে। সত্যের সন্ধান দেওয়া গণমাধ্যমের মৌলিক দায়িত্ব। সত্যটা অনেক সময় তেতো, অনেক সময় জনস্বার্থবিরোধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যায়। তবু সেটাই তুলে ধরতে হয়।

এখনই সময়, এই প্রবণতার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমের ভেতর থেকেই এক আত্মসংঘাত জাগ্রত হোক। সাংবাদিকেরা নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ হোন। পাঠক, দর্শক, সমাজ– এই তিনটির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সাংবাদিকতা যেন নিজস্ব নৈতিক অবস্থান বজায় রাখে।

আমরা যারা এই পেশার সঙ্গে জড়িত, আমাদের প্রত্যেকের উচিত প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করা– আমি কি সত্যের পক্ষে আছি, না কেবল ‘ভিউ’-এর দাস হয়ে গেছি? সংবাদপত্রের সম্পাদক, অনলাইন চ্যানেলের মালিক, নিউজরুমের বার্তা সম্পাদক কিংবা মাঠের রিপোর্টার—প্রতিটি স্তরে এই জবাবদিহি শুরু হওয়া দরকার।

পাঠকদেরও দায়িত্ব আছে। আপনি যদি বারবার গসিপ, অশ্লীলতা, চটকদার খবরই পড়েন ও শেয়ার করেন, তাহলে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ হারিয়ে যাবে। একজন সচেতন পাঠক হিসেবে আপনিও গণমাধ্যমকে দায়বদ্ধ রাখতে পারেন– প্রশ্ন করে, প্রতিবাদ করে, বিকল্প খুঁজে।

আমরা চাই, গণমাধ্যম আবার সত্যভিত্তিক আলোচনার জায়গা হয়ে উঠুক। মানুষ জানুক– কীভাবে তাকে শাসন করা হচ্ছে, কোথায় তার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, কীভাবে উন্নয়নের আড়ালে ঢেকে রাখা হচ্ছে অন্যায় ও দুর্নীতি।

আমরা যদি এভাবে চলি, তাহলে একদিন ‘গণমাধ্যম’ শব্দটাই শুধু শব্দকোষে রয়ে যাবে, বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা আজকের গণমাধ্যমকে হাস্যরসের উপকরণ বানিয়ে ফেলেছে, তাদের বোঝা উচিত—সংবাদ কোনো বিনোদন নয়। সংবাদ হলো গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, যা ভেঙে গেলে সমাজ হোঁচট খায়, রাষ্ট্র দুর্বল হয়।

বিজ্ঞাপন

একজন সৎ সাংবাদিক মানে কেবল একজন পেশাদার মানুষ নয়; সে সমাজের চোখ, বিবেক এবং প্রতিবাদের কণ্ঠ। আমরা যদি এসব কণ্ঠকে বিক্রি করে দিই ভিউ আর শেয়ারের কাছে, তাহলে আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দেব ভোঁতা এক অস্ত্র—যা শাসকের পক্ষে কথা বলবে, জনতার নয়।

তাই আহ্বান রইল– সাংবাদিকতা হোক সাহসের, সত্যের, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর হাতিয়ার। আমরা যারা মঞ্চে নই, ক্যামেরার পেছনে আছি, কলমের ডগায় আঙুল রাখি—আমরাই বদলে দিতে পারি দৃশ্যপট। আর পাঠক, আপনি যে লিংকে ক্লিক করছেন, সেটাই নির্ধারণ করছে ভবিষ্যতের সংবাদপত্র কেমন হবে। সচেতন হোন।

আমরা ভুলে যাচ্ছি গণমাধ্যম যতখানি খবর দেয়, ততখানিই ইতিহাস রচনা করে। যে সংবাদ আজ ছাপা হচ্ছে, তা হয়তো কালকে কোনো প্রজন্মের সামনে সত্যের দলিল হয়ে উঠবে। আমরা কী সেই সত্যকে বিকৃত করে ইতিহাসের সামনে দাঁড়াতে পারি?

সাংবাদিকতা কোনো চাকরি নয়, এটি এক মহান দায়িত্ব। সত্য বলার সাহস, অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর শক্তি এবং অবহেলিতের কণ্ঠ হয়ে ওঠার ব্রত নিয়েই একজন সাংবাদিককে এগোতে হয়। আর এই সাহসিকতাই গণমাধ্যমকে গৌরবময় করে তোলে। যতদিন না আমরা এই নৈতিক দায়বদ্ধতা অনুভব করি, ততদিন গণমাধ্যমের ভূমিকা সঠিকভাবে পালিত হবে না। এখনই সময় গণমাধ্যমের নতুন পথচলা শুরু করার। আমাদের হাতে এখন অমূল্য একটি সুযোগ—মানুষের সঠিক তথ্য জানানো, সমাজের সঠিক চিত্র তুলে ধরা এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। পাঠকও তার ভূমিকা পালন করতে পারেন—এটা মনে রেখে সাংবাদিকতার ভূমিকা ঠিক রাখতে হবে।

‘পাবলিক কি খায়’ এই প্রশ্ন নয়, বরং ‘পাবলিককে কী জানানো দরকার’– এই প্রশ্নই হোক সাংবাদিকতার আগামী দিনের পথচিহ্ন।

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

পাবলিক মুক্তমত সুদীপ্ত শামীম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর