রাজনীতি কোনো কল্পনার বিষয় নয়; এটি একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া, যা একটি জাতির জীবনধারাকে প্রভাবিত করে প্রতিটি স্তরে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কেবল ক্ষমতার কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তা সমাজের প্রত্যন্ত প্রান্তেও দোলা দেয়। কিন্তু যখন রাজনীতি হারায় তার ভারসাম্য, তখন দেশ এক অদৃশ্য সংকটে পড়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতা একটি দেশের উন্নয়নপ্রবাহকে থামিয়ে দিতে পারে, সমাজে তৈরি করতে পারে বিভাজন, আর মানুষের মনে গেঁথে দিতে পারে শঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশার চিত্র।
রাজনৈতিক অস্থিরতা কেবল কোনো দলের প্রতি বিরাগ কিংবা প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ নয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি মনস্তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক সমস্যা, যা ধীরে ধীরে একটি দেশের ভিত দুর্বল করে দেয়। এর জন্ম হতে পারে একটি ভুল সিদ্ধান্ত থেকে, একটি অবিচার থেকে কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের প্রবণতা থেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অস্থিরতা স্ফীত হতে থাকে, এবং একপর্যায়ে তা গোটা জাতির ভাগ্যকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।
এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার হয় সাধারণ মানুষ। যারা সকালের সূর্যে কাজের আশায় বেরিয়ে পড়ে, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরিশ্রম করে, তারাই প্রথম ধাক্কা খায় এই অস্থিরতা থেকে। যখন রাস্তাঘাট অবরুদ্ধ হয়, যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে, তখন তাদের জীবনে নেমে আসে স্থবিরতা। হঠাৎ কোনো ধর্মঘট, হরতাল বা সংঘর্ষের কারণে অনিরাপদ হয়ে পড়ে শহর কিংবা গ্রামের একান্ত গলি। যেকোনো সময় কোথাও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে, কোনো নিরীহ প্রাণ হয়তো হারিয়ে যেতে পারে রাজনীতির নিষ্ঠুর খেলায়। অথচ এই মানুষগুলোই নির্বাচনে ভোট দেয়, গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট থাকে।
অবাক করার বিষয় হলো, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রায়ই তৈরি হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে, কিন্তু এর ফল ভোগ করে সেই মানুষগুলো, যাদের এই ক্ষমতার লড়াইয়ের সাথে সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। নানা রকম রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার দিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা হয় নির্বাচনের সময়, কিন্তু নির্বাচনের পরে যে সংকট শুরু হয়, তা যেন জনসাধারণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে পড়ে অচল। দেশের ছোট-বড় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক বিরোধের বলি হয়ে যায়। একটার পর একটা পরীক্ষা পিছিয়ে যায়, পাঠ্যক্রমের ধারা ব্যাহত হয়। হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। শিক্ষার এই অচলাবস্থা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি নয়, বরং পুরো জাতির ভবিষ্যতের জন্য ভয়ানক সংকেত বহন করে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব ভয়াবহ। যখন কোনো দেশে অস্থিরতা বিরাজ করে, তখন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকে। উৎপাদন কমে যায়, রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ থেমে যায়। একসময় দেশের অর্থনীতিতে দেখা দেয় স্থবিরতা, যা শেষ পর্যন্ত কর্মসংস্থান হ্রাস এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। যখন সমাজে হিংসা, প্রতিহিংসা ও অশান্তি ক্রমাগত দেখা যায়, তখন সহনশীলতা ও সহানুভূতির জায়গায় স্থান নেয় অসহিষ্ণুতা। মানুষ একে অপরকে সন্দেহ করতে শেখে, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যায়। রাজনীতির নামে দলীয় বিভাজন সমাজে এমন এক বিভ্রান্তির জন্ম দেয়, যার ফলে পরিবারের ভেতরেও মতভেদ গড়ে ওঠে। একসময় ব্যক্তি তার পরিচয়ের আগে বলে ওঠে, সে কোন দলের, কোন মতাদর্শের অনুসারী।
রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি মারাত্মক প্রভাব পড়ে দেশের আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর। যখন রাজনীতি অস্থির হয়, তখন প্রশাসন হয় বিভ্রান্ত। একটি দলীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়, তবে সেখানে ন্যায়ের ধারণা নষ্ট হয়। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস হারায় রাষ্ট্রের ন্যায়বিচারে। বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এবং সেখানে দলীয় প্রভাবের অভিযোগ ওঠে।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি হয়, তা হলো জনগণের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া। তারা রাজনীতিকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করে, অথচ এটি একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ। জনগণ যদি রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে সেখানে জবাবদিহির সুযোগ কমে যায়, এবং একসময় রাজনীতি হয়ে পড়ে কিছু গোষ্ঠীর হাতের খেলনা।
সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, প্রতিবাদের অধিকার—এসবও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই অস্থিরতার মাঝে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মুক্ত গণমাধ্যম। কিন্তু যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে ওঠে, তখন ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী পক্ষ উভয়ই সংবাদ মাধ্যমকে নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে সত্য, নিরপেক্ষতা ও বিবেক অনেক সময় রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে পরাজিত হয়। জনগণের সামনে তখন যে সত্য পৌঁছে দেওয়ার কথা, তা আর পৌঁছায় না।
রাজনৈতিক অস্থিরতা যখন দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়, তখন তা কোনো নির্দিষ্ট সময় বা পরিস্থিতির সংকট হয়ে থাকে না; বরং এটি একটি প্রজন্মগত সমস্যা হয়ে ওঠে। যারা শিশুকালে রাজনৈতিক সহিংসতার পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তাদের মানসিকতায় নিরাপত্তাহীনতা, বিভাজনের মনোভাব, আর সামাজিক অসহিষ্ণুতার বীজ রোপিত হয়। এদের অনেকে রাজনৈতিক ঘৃণাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে এবং ভবিষ্যতে গঠনমূলক কাজের চেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রবণতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সমাজে একটি ভয়ানক সংস্কৃতি জন্ম নেয়—যেখানে অস্থিরতাই স্বাভাবিক, এবং স্থিতিশীলতা যেন কেবল একটি স্বপ্ন।
রাজনীতিতে অস্থিরতার কারণে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ব্যবস্থাও দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রকৃত নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ কমে যায়। মেধাবী, দক্ষ এবং দেশপ্রেমিক মানুষ রাজনীতিতে আগ্রহ হারায়। কারণ তারা দেখতে পায়, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে আদর্শ নয়, দরকার ক্ষমতার বলয়, হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও চাতুর্যপূর্ণ কৌশল। এর ফলে ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে আদর্শবাদী নেতৃত্ব হারিয়ে যায় এবং জায়গা নেয় গোষ্ঠীস্বার্থনির্ভর নেতাদের, যারা জাতীয় স্বার্থকে নয়, বরং দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।
এই অস্থিরতার মধ্য দিয়ে জাতীয় একাত্মতার ধারণাও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হলে প্রয়োজন অভিন্ন স্বপ্ন, অভিন্ন লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার মনোভাব। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন এবং অনবরত সংঘাত জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে, মানুষকে ভাগ করে ফেলে দলীয় পরিচয়ে, এবং একসময় দেশজুড়ে এক ধরনের মানসিক যুদ্ধ শুরু হয়—যেখানে নিজের চিন্তাধারা ছাড়া অন্য কোনো মতকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয় না।
রাজনৈতিক অস্থিরতা শুধু দেশের ভেতরেই প্রভাব বিস্তার করে না; এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলো সব সময় সেই দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী, যারা রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল। একটি রাষ্ট্রের সরকার যদি বারবার পরিবর্তিত হয়, হরতাল, বিক্ষোভ আর সহিংসতায় জনগণ আক্রান্ত হয়, তবে সেখানে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারায়। অনেক সময় আন্তর্জাতিক সাহায্য বা ঋণপ্রাপ্তিতেও জটিলতা দেখা দেয়। ফলে একটি রাষ্ট্র শুধু নিজের অভ্যন্তরীণ সংকটে আবদ্ধ থাকে না, বরং বিশ্বব্যবস্থায়ও পিছিয়ে পড়ে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করার জন্য কেবল আইন প্রয়োগ বা সাময়িক সমাধান যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন রাজনীতির সংস্কৃতি পরিবর্তন, নেতৃত্বের মনোভাব পরিবর্তন এবং জনসচেতনতার উন্মেষ। প্রথমেই যা প্রয়োজন, তা হলো—গণতান্ত্রিক চর্চা ও সহনশীলতা। রাজনীতিতে মতের ভিন্নতা থাকবেই, কিন্তু সেই ভিন্নতাকে যদি সহানুভূতির সাথে গ্রহণ করা যায়, তবে সংঘাত নয়, বরং সংলাপের মাধ্যমেই সমাধানের পথ তৈরি হতে পারে।
নেতৃত্বের মধ্যে দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও জবাবদিহির মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। জনগণের পাশে থেকে, তাদের প্রকৃত চাহিদা ও সমস্যাগুলো বুঝে কাজ করতে হবে। রাজনীতিকে শুধুমাত্র ক্ষমতার লড়াই হিসেবে না দেখে, একে জাতি গঠনের মাধ্যম হিসেবে দেখতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে দলীয় নেতৃত্বেও জবাবদিহিতা থাকে, এবং দল নিজেই একটি ক্ষুদ্র গণতান্ত্রিক সমাজ হয়ে ওঠে।
শিক্ষা ব্যবস্থা এবং গণমাধ্যমকেও ভূমিকা রাখতে হবে এই সংস্কৃতির গঠনে। তরুণদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, কিন্তু তা যেন সহিংসতার দিকে না ঠেলে দেয়, বরং যুক্তি, মানবিকতা ও অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্বের দিকে পরিচালিত করে। গণমাধ্যমকে হতে হবে নিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল এবং সাহসী—যেখানে সত্য প্রকাশ পাবে, মিথ্যার প্রচার রোধ হবে এবং জনগণ তথ্যভিত্তিক মত গঠন করতে পারবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—জনগণকে বুঝতে হবে, রাজনীতি কেবল রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়। এটি আমাদের সকলের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। তাই রাজনীতিকে শুদ্ধ করার দায়িত্ব কেবল রাজনীতিবিদদের নয়, বরং নাগরিক সমাজ, ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, শ্রমিক—সবার। যখন প্রতিটি মানুষ নিজ অবস্থান থেকে সৎ, মানবিক ও দায়িত্বশীল আচরণ করবে, তখন সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবেই।
দেশের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন, কারণ এটি উন্নয়নের পূর্বশর্ত। উন্নয়ন মানে কেবল সড়ক, ভবন কিংবা প্রযুক্তির প্রসার নয়; বরং উন্নয়ন মানে হলো মানবিক মূল্যবোধ, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, সুশাসন এবং সমতা। এই উন্নয়ন কখনোই রাজনৈতিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে সম্ভব নয়।
তাই সময় এসেছে আত্মসমালোচনার, সময় এসেছে নতুন করে ভাবার—আমরা কেমন সমাজ চাই, কেমন রাষ্ট্র চাই, এবং কীভাবে সেই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারি। যদি আমরা চাই একটি নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ, উন্নয়নমুখী রাষ্ট্র, তবে আমাদের প্রত্যেককে রাজনীতির ইতিবাচক সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। অস্থিরতাকে নয়, স্থিরতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ক্ষমতার জন্য নয়, দেশের জন্য রাজনীতি করতে হবে।
এইভাবে, রাজনৈতিক অস্থিরতা একটি জাতির ইতিহাসে যে কালো অধ্যায় রচনা করে, তা শুধু স্মরণ নয়—সাবধানতার সংকেত হয়ে থাকতে পারে। সেই সংকেতকে সামনে রেখে, নতুন প্রজন্মের হাত ধরে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব—যেখানে রাজনীতি হবে মানবতার জন্য, দেশের জন্য, জনগণের জন্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী