বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল—বিশেষ করে রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁওয়ের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে বছরের পর বছর ধরে খাদ্য উৎপাদন করে আসছে দেশের সবচেয়ে পরিশ্রমী ও অবহেলিত কৃষকেরা। ধান, আলু, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মরিচ, গম—এখানকার জমিতে যা রোপণ করা হয়, তা-ই যেন সোনা ফলায়। কিন্তু সেই সোনার মতো ফসলের ন্যায্য দাম আজও কৃষকের কপালে জোটে না।
উৎপাদনের সময় কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। ফসল ফলানোর আগে চাষ, সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচের পেছনে তার ব্যয় হয় হাজার হাজার টাকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সময়মতো পণ্য না পেয়ে বা জমিতে বন্যা নেমে যাওয়ার মতো বিপদও পেছনে নেই। এরপরও যখন ফসল ঘরে তোলে, তখনও সে শান্তি পায় না। কারণ তখন শুরু হয় আরেক যুদ্ধ—ন্যায্য দাম পাওয়ার লড়াই। এই লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হলো সিন্ডিকেট। একদল মজুদদার, মধ্যস্বত্বভোগী, পাইকার ও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মিলে গঠন করেছে এক অদৃশ্য শৃঙ্খল। এরা মাঠ পর্যায়ের কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ফসল কিনে নিলেও বাজারে সেই পণ্য বিক্রি করে কয়েকগুণ বেশি দামে। ফলে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে ব্যবসায়ীরা, আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয় কৃষক।
উদাহরণস্বরূপ, গত বছরের আলুর মৌসুমে দেখা গেছে—চাষের খরচ ৮-৯ টাকা হলেও কৃষক পেয়েছে কেজিপ্রতি মাত্র ৫-৬ টাকা। অথচ বাজারে সেই আলু বিক্রি হয়েছে ২৫-৩০ টাকা কেজিতে। একইভাবে ভুট্টা উৎপাদনের খরচ যেখানে ১৪-১৫ টাকা কেজি, সেখানে কৃষক পেয়েছে ১০-১১ টাকা, আর পরবর্তীতে তা বাজারে বেড়ে দাঁড়ায় ২০-২৫ টাকায়। ধান, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ—সব ফসলে একই অবস্থা।
সরকারি উদ্যোগের দুর্বলতা
সরকার প্রতিবছর ঘোষণায় বলে—প্রত্যক্ষভাবে কৃষকের কাছ থেকে ধান-গম-আলু কেনা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, স্থানীয় পর্যায়ের খাদ্যগুদাম ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কৃষকদের হয়রানি করে। প্রকৃত কৃষক চাষ করেছে—এই প্রমাণ দেখাতে গিয়ে নানা প্রকার কাগজপত্র, সার্টিফিকেট, স্থানীয় প্রতিনিধি বা নেতার সুপারিশ লাগে। ফলে প্রকৃত কৃষক সেই সুযোগ পায় না, আর মধ্যস্বত্বভোগী-দালালরাই বেশি লাভবান হয়। অনেক সময় দেখা যায়, এক ব্যক্তির নামেই সরকারি ক্রয়কেন্দ্র থেকে টানা কয়েকবার ফসল কেনা হয়েছে, অথচ তাঁর নিজের কোনো জমিই নেই! এই অনিয়ম রোধে স্থানীয় প্রশাসনের জবাবদিহি ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অভাব প্রকটভাবে দেখা যায়।
বাজারব্যবস্থায় নজরদারি নেই
বাজার ব্যবস্থাপনায় এখনো পর্যাপ্ত সরকারি তদারকি নেই। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে কোনও কার্যকর ভূমিকা নেই স্থানীয় প্রশাসনের, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কিংবা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। ফলে সিন্ডিকেট আরও সাহস পায়। স্থানীয় হাট-বাজারে ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে ‘একসাথে দাম কমাবে’ বা ‘একসাথে কিনবে না’—এই অবস্থা তৈরি করে কৃষককে বাধ্য করে কম দামে ফসল বিক্রি করতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষকের অভিযোগ শোনা হয় না, বাজার মনিটরিং কেবল শহরকেন্দ্রিক থাকে, ফলে গ্রামের হাটগুলো সিন্ডিকেটের দখলে চলে যায়। কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা ছাড়া কৃষক কখনোই ন্যায্য দাম পাবে না।
কৃষকের বিকল্প নেই, সিন্ডিকেটের আছে
কৃষকের একটি মাত্র বিকল্প—সে ফসল বিক্রি না করে জমিতে ফেলে রাখলে নষ্ট হবে। কিন্তু সিন্ডিকেটের অনেক বিকল্প আছে—তারা মজুদ করতে পারে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। তারা জানে, কৃষক বাধ্য, তার টাকা দরকার। ফলে সুযোগ নিয়ে গিলে ফেলে কৃষকের ঘাম ঝরানো রোজগার। কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর মতো শক্তিশালী কোনো সংগঠন নেই, নেই আইনি সহায়তাও। অন্যদিকে সিন্ডিকেটের আছে পুঁজি, প্রভাব, আর রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া—যা তাদের অপরাধকে আরও বেপরোয়া করে তোলে। এই অসম লড়াইয়ে কৃষক একা, অসহায়।
উপায় কী?
এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি বাস্তবধর্মী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি _
প্রকৃত কৃষকের তালিকা ও ডিজিটাল রেকর্ড: কৃষকের এনআইডি ও জমির খতিয়ান অনুযায়ী নির্ভরযোগ্য তালিকা তৈরি করে তা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ করতে হবে। এতে করে কৃষক সরাসরি সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা পাবে, মধ্যস্বত্বভোগীর সুযোগ থাকবে না।
প্রযুক্তিনির্ভর বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা: কৃষক যেন সরাসরি ভোক্তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে—সে জন্য সরকার-প্রণোদিত মোবাইল অ্যাপ, ‘কৃষক বাজার’, অনলাইন বিপণন প্ল্যাটফর্ম চালু করতে হবে। এতে কৃষকও লাভবান হবে, ভোক্তাও পাবে ন্যায্যমূল্যে পণ্য।
বাজার তদারকি ও সিন্ডিকেট দমন: বাজারে সিন্ডিকেট করে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও বাস্তবে এর প্রতিকার নেই। তাই নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, জরিমানা আদায় এবং আইনি ব্যবস্থার কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সাশ্রয়ী হিমাগার ও গুদাম সুবিধা: আলু, ধান, পেঁয়াজসহ কৃষিপণ্য যেন কৃষক সহজে সংরক্ষণ করতে পারে—সেই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গুদাম ও হিমাগার কৃষকের জন্য সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করতে হবে।
ন্যায্যমূল্য নির্ধারণে কৃষকের অংশগ্রহণ: কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণের সময় কৃষকের প্রতিনিধিদের মতামত বাধ্যতামূলক করতে হবে। শুধুমাত্র ব্যবসায়ী বা সরকারি কর্মকর্তাদের মতামতে মূল্য নির্ধারণ করলে তা কৃষকের পক্ষে যাবে না।
এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলেই কৃষক তার প্রাপ্য মর্যাদা ও ন্যায্য দাম পেতে পারে।
উত্তরের কৃষক আজ হতাশ, কিন্তু তারা হেরে যায়নি
উত্তরের কৃষক হতাশ—কারণ তার পরিশ্রমের মূল্য সে পায় না। কিন্তু সে হেরে যায়নি। এখনো সে মাঠে নামে, চাষ করে, রোজ সকালে হাল ধরে। এই কৃষকের চোখে আজও স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্নকে বাস্তব করতে হলে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে, ব্যবসায়িক শোষণ থেকে কৃষককে রক্ষা করতে হবে। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে—এটা স্লোগান নয়, বাস্তব সত্য। তাই এই মুহূর্তে প্রয়োজন নীতিনির্ধারকদের সদিচ্ছা, প্রশাসনের জবাবদিহি, কৃষকের প্রতি সম্মান এবং এক শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থা—যেখানে ফসল বিক্রি করে কৃষক মাথা উঁচু করে বাড়ি ফিরতে পারবে। না হলে একদিন এই দেশ শুধু খাদ্য সংকটে পড়বে না, বরং হারাবে তার সবচেয়ে বড় শক্তিকে— ‘কৃষক’কে।
লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক