চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ে জ্বালানির উপর নির্ভর করে একটি জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও জীবনযাত্রার গতি নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির তুলনায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার অতি প্রকট। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর এই নির্ভরশীলতা শুধুমাত্র দেশের অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করছে না, বরং পরিবেশ ও জলবায়ুর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এখন আর কেবল ভবিষ্যতের কল্পনা নয়- এটি বর্তমানের পরিবেশ রক্ষার্থে একটি জরুরি দাবি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এখনও সীমিত এবং নানা অবকাঠামোগত ও বাজেট ভিত্তিক সমস্যা একে ঘিরে আছে।
ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা, বৈদেশিক জ্বালানি আমদানি ব্যয় ও জলবায়ু সংকটের বাস্তবতায় এখন প্রশ্ন ওঠে- আমরা কি প্রস্তুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথ অনুসরণ করতে?
বর্তমান অবস্থা ও নীতিমালা
বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৪.৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসে,যা নিতান্তই সামান্য। এক্ষেত্রে সৌর শক্তির অবদান সবচেয়ে বেশি, যা মোট নবায়নযোগ্য শক্তির প্রায় ৭০ শতাংশ যোগান দেয়। সরকার ২০০৮ সালে Renewable Energy Policy প্রণয়ন করে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এছাড়া, ২০১৬ সালের Power System Master Plan অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ২০-৩০% নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। যদিও তৃতীয় বিশ্বের দেশের বাস্তবতায় এটি একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য, তবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত অসুবিধাগুলো এখনই অতিক্রম করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে উল্লেখ করা যায় – সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি এবং জলবিদ্যুৎ কে।
প্রথমত, সৌর শক্তি
বাংলাদেশের প্রায় পুরো ভৌগোলিক এলাকা সৌরশক্তির জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনা। গ্রামীণ অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় ৬০ লক্ষের বেশি সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে রুফটপ সৌর প্যানেলগুলো সরকারি ভবন, স্কুল, হাসপাতালসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে ব্যাটারি এবং ইনভার্টার আমদানির ওপর বেশি নির্ভরশীলতা – এর রক্ষণাবেক্ষণ ও খরচের ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ। দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ফিড-ইন ট্যারিফ নীতির মাধ্যমে সৌরশক্তি খাতকে আরও সম্প্রসারিত করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, বায়ু শক্তি
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো যেমন কক্সবাজার, কুয়াকাটা অঞ্চলে বছরে গড় বাতাসের গতি প্রায় ৫.৫ মিটার/সেকেন্ড বা তার বেশি। এই এলাকাগুলোতে বায়ু শক্তির বড় সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২২ সালে কক্সবাজারে পরীক্ষামূলকভাবে স্থাপিত ৬০০ কিলোওয়াট ক্ষমতার উইন্ড টারবাইন স্থাপন এ সম্ভাবনার প্রমাণ। তবে বায়ু শক্তি খাতে সঠিক তথ্যের অভাব, অপর্যাপ্ত গতিবেগ, ভূমিকম্প ঝুঁকি এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। এর সমাধানে প্রয়োজন যথাযথ উইন্ড রিসোর্স ম্যাপিং, বেসরকারি বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদান এবং প্রযুক্তিগত গবেষণায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গ্রহণের মতো পদক্ষেপ নেওয়া।
তৃতীয়ত, জলবিদ্যুৎ
বর্তমানে বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় উৎস হলো কাপ্তাই হাইড্রো পাওয়ার প্লান্ট, যার ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। ছোট নদী ও খালের পানির প্রবাহ কাজে লাগিয়ে মিনি এবং মাইক্রো হাইড্রো প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে পাহাড়ি ও পর্বতশ্রেণী এলাকায়। কিন্তু মৌসুমভিত্তিক জলপ্রবাহের পার্থক্য এবং ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে বৃহৎ স্কেলের হাইড্রো পাওয়ার জেনারেটের সম্ভাবনা সীমিত। এসব সমস্যার সমাধান করতে সেচের পানির সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমন্বিত প্রকল্প ও সিজনাল হাইড্রো সলিউশন গড়ে তোলা জরুরি।
মোটকথা, বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে প্রধান সমস্যাগুলো হলো _
নীতিগত ও প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির অবকাঠামো অপর্যাপ্ত, যা প্রকল্প বাস্তবায়নে অস্পষ্টতা এবং বিলম্বের কারণ হয়।
প্রযুক্তিগত নির্ভরতা ও দক্ষতার অভাব
বিদেশি যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভরতা যেমন সৌর প্যানেল, ব্যাটারি ও ইনভার্টার আমদানির জন্য অর্থবহ ব্যয়, তেমনি স্থানীয় দক্ষ মানবসম্পদের অভাব প্রকল্পের টেকসই ব্যবস্থাপনাকে ব্যাহত করে।
অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা ও জটিলতা
সবুজ অর্থায়ন বা গ্রিন ফান্ডের ব্যবহার দেশে সঠিক মাত্রায় প্রসারিত হয়নি। ব্যাংকিং সেক্টরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের জন্য স্বচ্ছ, সহজলভ্য ঋণ ব্যবস্থা না থাকায় বিনিয়োগ কম।
রাজনৈতিক ও কর্পোরেট চাপ
জীবাশ্ম জ্বালানি খাতের শক্তিশালী লবিং ও রাজনীতির কারণে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রতি সরকারি ও বেসরকারি উৎসাহ কম।
সামাজিক সচেতনতার অভাব
জনসাধারণের মধ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যাপারে পর্যাপ্ত সচেতনতা ও গ্রহণযোগ্যতা নেই, যা প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তারে বাধা সৃষ্টি করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি
ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্থাপনা ধ্বংসের ঝুঁকি বাড়ায়, যা স্থায়ী ব্যবস্থাপনা ও উন্নত প্রযুক্তির অভাবের কারণে প্রকল্প ব্যর্থ করে।
উত্তরণের কৌশল ও সুপারিশ
জাতীয় পর্যায় থেকে সরকারকে অবশ্যই নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য একটি সমন্বিত আইন ও নীতি প্রণয়ন ও দ্রুত হালনাগাদ করতে হবে। এই কাজে দেশীয় প্রযুক্তি উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন, যেমন সৌর প্যানেল, ব্যাটারি এবং ইনভার্টারের স্থানীয় শিল্পায়ন করা জরুরি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহায়তা ও ঋণ উৎস (Green Climate Fund, ADB, JICA) দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে অর্থায়ন বিস্তার করতে হবে।
দেশীয় পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি এবং সফল প্রকল্পের প্রচার চালাতে হবে, যেমন- নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার এবং ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে শিক্ষাক্রমে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ।এছাড়াও অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি, যেমন “Solar for Agriculture”, “Wind for Coastal Areas”, “Hydro for Hill Regions”। সর্বোপরি অফিস গ্রিড ও স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিস্তার করতে হবে যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্থিতিশীল হয়।
বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের উন্নয়ন পরিবেশ সুরক্ষা ও জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে, সবুজ শক্তির ব্যবহার বাড়ানো মানে শুধু অর্থনৈতিক সাশ্রয় নয়, একদৃষ্টিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম করা। সুশাসন, প্রযুক্তি উন্নয়ন, অর্থায়ন নিশ্চিতকরণ এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাংলাদেশকে একটি সবুজ, উন্নত ও স্থিতিশীল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়