সকালে ঘুম থেকে উঠে যে জিনিসগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো প্লাস্টিক। টুথব্রাশ, পানি খাওয়ার বোতল, খাবারের প্যাকেট, বাজারের ব্যাগ, শিশুর খেলনা, এমনকি ওষুধের পাতা পর্যন্ত সবখানে প্লাস্টিক। সহজে ব্যবহার করা যায়, সস্তা, হালকা এইসব সুবিধার কারণে মানুষ প্লাস্টিকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই সুবিধার আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ এক বিপদ প্লাস্টিক দূষণ।
প্লাস্টিক সহজে মাটিতে মিশে না। শত শত বছরেও তা নষ্ট হয় না। একটি প্লাস্টিক বোতল সম্পূর্ণভাবে মাটিতে মিশতে সময় নেয় ৪০০ থেকে ৫০০ বছর! ফলে প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে যতো প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, তা জমে জমে একেকটা অদৃশ্য পাহাড়ে পরিণত হচ্ছে।
প্রতি বছর উৎপাদিত প্লাস্টিকের অর্ধেকই একবার ব্যবহারযোগ্য। এর মধ্যে মাত্র ৯% রিসাইক্লিং হয়, বাকি ৯১% গিয়ে পড়ে মাটিতে, নদীতে বা সাগরে। ফলে পরিবেশ, প্রাণিকুল এমনকি মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে এই বিষ।
সাগরে পড়ে থাকা প্লাস্টিক প্যাকেট বা বোতলকে খাবার ভেবে খেয়ে ফেলছে সামুদ্রিক প্রাণীরা। পেটে জমে থাকা এসব প্লাস্টিকের কারণে প্রাণীগুলো ধীরে ধীরে মারা যায়। মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা আজ মানুষের রক্ত, মাছের পেট এবং এমনকি মাতৃদুগ্ধেও পাওয়া যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ গড়ে প্রতি সপ্তাহে একটি ক্রেডিট কার্ড পরিমাণ প্লাস্টিক খেয়ে নিচ্ছে।
প্লাস্টিক দূষণের মূল কারণ আমাদের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং অসচেতনতা। অনেকেই জানেন না প্লাস্টিকের ভয়াবহতা সম্পর্কে। দোকানে গিয়ে ছোট একটি জিনিস কিনলেও প্লাস্টিক ব্যাগে নিয়ে আসি। পানি খাওয়ার জন্য প্রতিদিন কিনি বোতলজাত পানি। এসব বোতল, ব্যাগ, মোড়ক আমরা ফেলে দিই রাস্তায়, নালায় বা ডাস্টবিনে। কিন্তু জানি না, এগুলোর গন্তব্য হয় নদী-নালা, খোলা মাঠ বা সাগরের পাড়।
আরেকটি কারণ হলো বিকল্প ব্যবহারের অভাব। পরিবেশবান্ধব পণ্য যেমন পাট বা কাপড়ের ব্যাগ সহজে পাওয়া যায় না, আবার তা তুলনামূলক দামেও বেশি। পরিবেশবান্ধব পণ্যের সহজলভ্যতা না থাকায় মানুষ বাধ্য হয় প্লাস্টিক ব্যবহার করতে।
বড় শহরগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। শুধু শহর নয়, গ্রামের খাল-বিল, নদী-নালাতেও প্লাস্টিক ভেসে বেড়ায়। এসব বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় তা জমে ড্রেন বন্ধ করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। বর্ষাকালে এই সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে। অনেক সময় এসব প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলা হয়, যার ফলে বাতাসে ছড়ায় বিষাক্ত গ্যাস যা মানুষের ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে সবচেয়ে বড় সমাধান হলো সচেতনতা। আমরা যদি নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেই যে প্লাস্টিক ব্যবহার কমাব, তাহলে পরিবর্তন শুরু হবে। বাজারে গেলে কাপড় বা পাটের ব্যাগ নিয়ে যাওয়া, বোতলজাত পানি না কিনে রিফিলযোগ্য বোতল ব্যবহার, একবার ব্যবহারযোগ্য স্ট্র, কাপ, প্লেট ইত্যাদি না ব্যবহার করা, প্লাস্টিক না ফেলে পুনর্ব্যবহার বা রিসাইক্লিংয়ের জন্য আলাদা রাখা ইত্যাদি হতে পারে আমাদের অন্যতম পদক্ষেপ।
এছাড়া সরকারি উদ্যোগও জরুরি। প্লাস্টিক ব্যাগ ও অন্যান্য নিষিদ্ধ পণ্য বাজারে বিক্রি বন্ধ করতে হবে। যারা নিয়ম মানছে না, তাদের জরিমানা করতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পণ্য তৈরির জন্য উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দিতে হবে। পাট, কাগজ বা বাঁশ দিয়ে তৈরি পণ্য উৎপাদনে ভর্তুকি দিতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ তা সাশ্রয়ী দামে কিনতে পারে।
আরেকটি বড় কাজ হলো, প্লাস্টিক পুনঃব্যবহার বা রিসাইক্লিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। প্লাস্টিক সংগ্রহ করে যারা জীবিকা চালায়, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি করা এবং সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করা উচিত।
সবচেয়ে বড় কথা, এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। শিশু থেকে বৃদ্ধ, শিক্ষার্থী থেকে ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই যদি সচেতন হই, তবে এই বিপদ রোধ করা সম্ভব। একটি শিশু যদি ছোটবেলা থেকেই শিখে “প্লাস্টিক খারাপ, পাট ভালো”, তাহলে সে কখনোই বড় হয়ে প্লাস্টিক ব্যবহারে উৎসাহ পাবে না। তাই পরিবারেই শুরু হোক সচেতনতার প্রথম পাঠ। পাশাপাশি স্কুল-কলেজে প্লাস্টিকবিরোধী ক্যাম্পেইন, সচেতনতামূলক দেয়ালিকা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা বা র্যালির আয়োজন করলে অনেকেই এই সমস্যা সম্পর্কে জানবে। ‘Reduce, Reuse, Recycle’ বা ‘3R’ নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্লাস্টিকবিরোধী বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
প্লাস্টিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সংকট। এই দূষণ দূষণ কোনো ভবিষ্যতের সমস্যা নয়, এটি এখনকার সমস্যা। এটি মোকাবিলা করতে হলে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছোট ছোট পরিবর্তন এনে আমরা এই দূষণ রোধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারি। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীকে বসবাসযোগ্য রাখতে হলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে, আর তার জন্য প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে এখনই রুখে দাঁড়াতে হবে। এখনই যদি আমরা জেগে না উঠি, ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানরা পাবে না একটিও পরিষ্কার নদী, পাবে না নিশ্বাস নেওয়ার নির্মল বাতাস।
লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়