৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনি সময়’। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে পরিবেশ রক্ষার তাগিদ থেকে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মানুষের সাথে প্রকৃতি-পরিবেশের সম্পর্ক সৃষ্টির সেই শুরু থেকেই। পরিবেশ-প্রকৃতিকে পাশ কাটিয়ে বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ নেই। সমুদ্র ও গাছপালা অক্সিজেন বিলিয়ে পৃথিবীর প্রাণীকুলকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু আবার সেই প্রকৃতির সাথে মানুষ যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে। ক্ষেত্রবিশেষে মানুষ প্রকৃতি ধ্বংসের খেলায় মেতেছে! একবিংশ শতাব্দীতে এসে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে তা হলো পরিবেশ দূষণ। জলবায়ু পরিবর্তন পুরো পৃথিবীর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পরিবেশগত সমস্যার মূল কারণ হিসেবে মানুষকে দায়ী করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা না থাকার ফলে পরিবেশ রক্ষা করা কঠিন বটে। পরিবেশ সচেতনতা গড়ে না উঠায় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস গাছ প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও গাছটি লাগানো থেমে নেই! পরিবেশের জন্য ক্ষতি জেনেও নিষিদ্ধ পলিথিন সবার হাতে হাতে। অনেক চেষ্টার পরেও পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার রোধ করা যাচ্ছে না। সরকার থেকে নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও মানুষের সাড়া মেলেনি। প্লাস্টিকের ব্যবহার অযাচিতভাবে বাড়ছে। মানুষের নিত্য ব্যবহার্য বেশিরভাগ পণ্য এখন প্লাস্টিকের। সহজে ব্যবহারযোগ্য ও দাম নাগালের মধ্যে থাকায় হরহামেশাই প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। চারদিকে দূষণের ছড়াছড়ি। যেন দূষণের প্রতিযোগিতা চলছে! চালকদের মধ্যে শব্দ সচেতনতা নেই। পরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না উঠায় বর্জ্যরে বড় একটি চলে যাচ্ছে নদী ও খাল-বিলে। চাইলে জলাশয় ভরাট করার নিয়ম নেই। অথচ আইন ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে। বাসাবাড়ির পয়োঃনিষ্কাশন ও বর্জ্যরে লাইন জুড়ে দেওয়া হচ্ছে নদী ও খালের সাথে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে চলছে বৃক্ষনিধন। নদীমাতৃক বাংলাদেশে দখল আর দূষণের কারণে নদীগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে নদীর স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। যা নদীভাঙনকে ত্বরান্বিত করছে। বায়ুদূষণের কবলে পড়ে বাড়ছে রোগবালাই।
আসলেই কী মানুষ আর পরিবেশ একে অপরের প্রতিপক্ষ? মানুষ নিজেও জানে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কখনো টিকে থাকতে পারবে না। প্রকৃতিকে রক্ষা করেই মানুষকে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতি নিজেই নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে পারে। কিন্তু যখন মানুষের প্রকৃতিবিরুদ্ধ কার্যকলাপ মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন প্রকৃতি নিজেই প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তার শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে। মানুষতো কখনোই প্রকৃতি-পরিবেশের বিরুদ্ধে ছিলই না। তাহলে হঠাৎ কেন একবিংশ শতাব্দীতে এসে পরিবেশ রক্ষা নিয়ে গলা ফাটাতে হচ্ছে? একটা সময় তো মানুষ জীবনের সবকিছুই প্রাকৃতিকভাবে ও সরাসরি পরিবেশ-প্রকৃতি থেকেই পেত। যে আদি মানুষ পরিবেশের সাথে মিলেমিশে বড় হয়ে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে তাকে কেন নতুন করে পরিবেশ সচেতনতার কথা বারবার শিখিয়ে দিতে হবে? জাপানের মানুষকে তো একটা সময়ের পর আর পরিবেশ রক্ষার কথা বলা লাগে না? পার্শবর্তী মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল ও ভুটানের মানুষ অনেক বেশি পরিবেশ সচেতন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রাজধানী শহর কত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সে তুলনায় ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট অনেক বেশি নোংরা ও দূষণে জর্জরিত।
পরিবেশ ধ্বংসের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রকৃতিবিরুদ্ধদের মাত্রাতিরিক্ত লোভ। এমনতো নয় মানুষ পরিবেশ রক্ষার জন্য কোনটা করা উচিত আর অনুচিতের বিষয়টি জানে না! বিষয়টি হলো মানুষ জানে কিন্তু মানে না। যে মানুষ খাল দখল করে সুবিধা পাচ্ছে সে আবার বর্ষা মৌসুমে সেই সুবিধার দরুণ জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত হচ্ছে। বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলার কারণে মানুষ যে সুবিধা পাচ্ছে পরের দিন সেই বর্জ্য দূষণের কারণে আবার রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যে পলিথিন-প্লাস্টিক ব্যবহারের কারণে মানুষ আরাম পাচ্ছে সেই পলিথিন- প্লাস্টিকের দূষণে মানুষ অজান্তেই নিজের শরীরে রোগেই জন্ম দিচ্ছে। অর্থাৎ মানুষের সৃষ্ট পরিবেশগত সমস্যার কারণে মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে, এলাকার নদী ও খাল দখল করে আছে রাজনৈতিকভাবে কোনো প্রভাবশালী। আবার দেখা যাচ্ছে, রাস্তায় একজন একাধারে হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে- অথচ তার কোনো শাস্তি নেই। ছোট ট্রাকে লাগানো হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সের হর্ন। ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে চারপাশ। বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামে সমিতি করে চলছে লুটপাট! সহজ কথায়, একজন পরিবেশ সচেতন মানুষও চারপাশের অনিয়ম দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে সেইও অসচেতন হয়ে পড়ছে! পরিবেশ দূষণের অর্থনৈতিক ক্ষতি মারাত্মক। মানুষ যখন নিজের অসচেতন কার্যকলাপে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন ক্ষতিটা হয় ব্যাপক। বলা হয়ে থাকে, মানুষের রোগবালাইয়ের অর্ধেকের বেশি হয়ে থাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মকা- থেকে। পরিবেশের প্রতিটি সমস্যা প্রতিরোধে সরকারের আইন আছে। কিন্তু সে আইনও যথাযথ প্রয়োগ হয় না। আর প্রয়োগ না করা করার ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রতিটি উপাদান আজ ক্ষতিগ্রস্ত। যা পুরো মানবজীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মানুষ চাইলে পরিবেশ রক্ষা করতে পারে। প্রকৃতির সন্তান মানুষ স্বাভাবিকভাবে পরিবেশ সচেতন। কিন্তু মানুষের সেই পরিবেশ সচেতনতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না শুধু চারপাশের প্রকৃতিবিরুদ্ধ ও লোভীদের অব্যবস্থাপনার কারণে। প্রকৃতিবিরুদ্ধ-অসচেতন ও পরিবেশ থেকে অবৈধ সুবিধাধারীদের থামাতে না পারলে পরিবেশের ক্ষতি রোধ করা যাবে না। এছাড়া সব বয়সী মানুষ ও শিক্ষার্থীদের পরিবেশ শিক্ষা দরকার সবার আগে। শুধু আইন করলেই হবে না। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন না থাকলে সে আইন থেকেও কোনো লাভ নেই। সরকার আইনের কার্যকর করার দায় এড়াতে পারে না। মানুষ নিজেদের স্বার্থে সচেতন না হলে পরিবেশ রক্ষা করা সত্যিই কঠিন। পরিবেশধ্বংসকারী শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনের কঠোর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে মানুষের সচেতনতা ফিরে আসবে।
লেখক: শিক্ষক, জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী