বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-মধ্যাঞ্চলের ১১টি জেলা বর্তমানে ভয়াবহ বন্যার কবলে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরগুনা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, নীলফামারী এবং লালমনিরহাটে নদনদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গ্রাম, বাড়িঘর, ফসলি জমি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই বিপর্যস্ত। গোলাপগঞ্জে টিলা ধসে একই পরিবারের চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং পাঁচ শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের টিলার পাদদেশে বসবাস বন্যার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। বেড়িবাঁধগুলোতে ফাটল ও ভাঙন বর্ষা মৌসুমে আরও বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি করেছে।
বন্যার কারণসমূহ:
বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং উজানে ভারতের অবিরাম বর্ষণ এই বন্যার মূল কারণ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম ও উত্তরবঙ্গে প্রবল বৃষ্টির কারণে উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল সরাসরি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করে। ভারতের অভিন্ন নদনদীতে যখন বাঁধ খুলে দেওয়া হয় বা অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন তা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক তথ্যবিনিময় ও সমঝোতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে ইচ্ছাকৃত ও হঠকারীভাবে পানি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে—শুষ্ক মৌসুমে পানি না দিয়ে শুষ্কতা বাড়ানো হয়, আর বর্ষায় বাঁধ খুলে দিয়ে বিপুল পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যা ঘটানো হয়।
এছাড়াও, নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, কর্ণফুলীসহ শত শত ছোট-বড় নদীর অবস্থা শোচনীয়। এই নদীগুলো এখন আর সঠিকভাবে নদী বা জলাধার হিসেবে কাজ করতে পারছে না। ফলে বৃষ্টির পানি এবং সীমান্ত পেরিয়ে আসা বর্ষার পানি নদীতে সঙ্কুচিত হয়ে আশেপাশের স্থাপনাগুলো তলিয়ে যাচ্ছে।
ব্যর্থতার দায়ভার ও অব্যবস্থাপনা:
বন্যা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বেড়িবাঁধ ও বন্যানিরোধের নির্মাণে টেকসই সমাধানের পরিবর্তে বরাদ্দকৃত অর্থের অপব্যবহার এবং প্রকল্পের গুণগত মানহীনতা প্রকট। প্রতি বছর সংস্কার প্রকল্প নেওয়া হলেও কাজ ঠিকমতো হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দোষীদের বিরুদ্ধে দায়বদ্ধতা গ্রহণে আগ্রহ দেখায় না। নদী খনন, পুনর্গঠন এবং টেকসই বন্যানিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপরতার অভাবই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ।
কোটি কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নেওয়া হলেও আসল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধগুলো সামান্য চাপেই ভেঙে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ছে, যা আগামীতে দেড় কোটি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করতে পারে—এগুলো গত বছরেরই পূর্বাভাস। অথচ দীর্ঘমেয়াদি কোনো টেকসই পরিকল্পনা নেই। বালু ভরাট, বাঁধের দুর্বলতা, বরাদ্দ লোপাট—সব মিলিয়ে ব্যবস্থা শূন্য।
বন্যা মোকাবিলায় অবিলম্বে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা অপরিহার্য _
১. জরুরি মূল্যায়ন ও সমন্বয়:
পাউবোকে সক্রিয় ও জবাবদিহিমূলক করে তোলা: নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে প্রতিটি বেড়িবাঁধ, বন্যানিরোধ ও নদী খনন প্রকল্প নিয়মিত পরিদর্শন করা হয়। প্রকল্পের সার্বক্ষণিক অগ্রগতি অনলাইনে আপলোড করতে হবে।
আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়: পানি উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সমন্বয়ে একটি ‘সুপার ক্লাস্টার’ গঠন করতে হবে। এখানে অর্থ, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ একত্রিত করে মেগা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে।
২. বন্যানিরোধ ও বেড়িবাঁধের গুণগত মান বৃদ্ধি:
টেকসই নকশা ও উপকরণ: ঢালাই-বাঁধ নির্মাণে পলিমার-নেট, বায়োস্যাচুরেশন প্রযুক্তি ও জীবাশ্মভিত্তিক বেড়িবাঁধ উপকরণ ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদী মজবুত বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
নিয়মিত প্রযুক্তিগত নিরীক্ষা: বাঁধের ভাঙন বা ফাটল দেখা দিলে তাৎক্ষণিক মেরামত করতে হবে। ছোটখাটো ত্রুটির প্রতিকারে সঠিক প্রকৌশলী দল দিয়ে কাজ করতে হবে।
দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ: ঠিকাদারদের ভুল-ত্রুটির ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং দুর্নীতির অভিযোগে স্বশাসিত তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।
৩. নদী ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা:
নদী খনন ও পুনর্গঠন: গুরুত্বপূর্ণ স্তরে নদী খনন করে পানিস্রোত মসৃণ করতে হবে, যাতে পাহাড়ি ঢলের পানি দ্রুত সাগরে পৌঁছাতে পারে এবং পানি জমে থাকার সময় কমে।
বাঁধ ও নদীর মধ্যবর্তী দূরত্ব পরিকল্পনা: নদীর দুই পাড়ের মধ্যে নগরায়ন ও স্থাপনার দূরত্ব বাড়াতে হবে, যাতে বাঁধ ভাঙার আশঙ্কায় ক্ষয়ক্ষতি কমে। সংরক্ষিত ‘গ্রীনবেল্ট’ পরিকল্পনা অপরিহার্য।
প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ: ছোট-বড় হাওর, বিল ও জলাভূমি পুনরুদ্ধার করে সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে, যা বন্যার অতিরিক্ত পানি ধারণে ভূমিকা রাখবে।
৪. প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি:
গ্রাম পর্যায়ে জরুরি ত্রাণ ব্যবস্থা: প্রতিটি ইউনিয়নে ‘বন্যা সীফন সিঙ্ক’ সাইনবোর্ড স্থাপন করতে হবে। নিম্নাঞ্চলীয় মানুষকে দ্রুত সরিয়ে নিতে স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
সচেতনতা ও প্রস্তুতি: বন্যা মোকাবিলায় করণীয়, নিরাপদ স্থান এবং জরুরি ফোন নম্বর সম্পর্কে শিশু, কিশোর, মহিলাসহ সকলকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এসএমএস-ভিত্তিক সতর্কবার্তার মতো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যা সংকেত পৌঁছে দিতে হবে।
৫. আন্তর্জাতিক সমঝোতা ও তথ্যবিনিময় ত্বরান্বিত করা:
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কার্যকরী তথ্যবিনিময়: নদী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিদ্যমান সমঝোতার কার্যকারিতা পুনর্বিবেচনা করে একটি বাধ্যতামূলক তথ্যবিনিময় কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। ভারতের উজানে অতিবৃষ্টি বা বাঁধ খুলে দেওয়ার তথ্যে তাৎক্ষণিক ‘উদ্বোধন-উত্তর সতর্কবার্তা’ নিশ্চিত করতে হবে।
বৈশ্বিক পানি সম্মেলনে অংশগ্রহণ: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক তহবিল এবং উন্নত প্রযুক্তি আহরণে সক্রিয়ভাবে বৈশ্বিক পানি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে হবে।
৬. উপকূলীয় এলাকার টেকসই সমাধান:
বডি-বিগ্রেডেড বেড়িবাঁধ: উপকূলীয় অঞ্চলে জিওটেক্সটাইল, পাইলিং ও উদ্ভিদভিত্তিক দৃঢ় বাঁধ প্রযুক্তি সমন্বয়ে দীর্ঘ এবং বহুমাত্রিক বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
জলবায়ু অনাগ্রাসনশীল ভূমি: সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকির মুখে থাকা এলাকায় মনুষ্যবসতি সরিয়ে নিরাপদ উচ্চ ভূমিতে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা নিতে হবে। সমন্বিত কৃষি ও মৎস্যচাষের মাধ্যমে উপকূলবাসীকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে হবে।
মেগা প্রকল্পের কার্যকর বাস্তবায়ন: উপকূলের মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে দীর্ঘমেয়াদী অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে, যেমন বঙ্গোপসাগরে সুরক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণ।
৭. দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ:
স্বচ্ছ বাজেট তদারকি: বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহার এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটি মাসিক ও ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন পেশ করবে।
দুর্নীতি দমন: বন্যা মোকাবিলায় বরাদ্দকৃত অর্থে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া চালু করতে দুর্নীতিবিরোধী ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
৮. দীর্ঘমেয়াদি মন্থন ও সমীক্ষা:
স্থানীয় সমস্যা-সমাধান কেন্দ্র: প্রতিটি জেলার স্থানীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আলাদা ‘বন্যা প্রতিরোধ নকশা’ তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে হবে।
পারিপার্শ্বিক পরিবেশ রক্ষা: বন উজাড় এবং পাহাড় কাটা বন্ধ করে বন্যা প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে। গাছপালা রোপণ ও নতুন সেচ পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে।
বন্যা বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, এটিকে একটি স্বাভাবিক দুঃস্বপ্ন হিসেবে মেনে নেওয়া যায় না। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলকে সাময়িকভাবে আটকানোর উপায় আমাদের হাতে না থাকলেও, এর প্রভাব সীমিত করার সব ব্যবস্থা আমাদের আয়ত্তে রয়েছে। নদী খনন, বেড়িবাঁধ সংস্কার, স্থানীয় প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক তথ্যবিনিময় ও টেকসই উপকূল রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে এই ভয়াবহতা কমানো সম্ভব।
এখনই সময় হাতেগোনা করে উদ্যোগ নেওয়ার—পাউবোকে কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে, সমন্বিত মেগা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে, নদী সংরক্ষণ ও বন্যানিরোধকে টেকসই করতে এবং উপকূলবাসীকে নিরাপদ জায়গায় বসতি গড়ে তুলতে। এভাবেই ধীরে ধীরে একান্ত জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ করার ফলে বন্যার হাত থেকে জীবন ও সম্পদ বাঁচবে, এবং বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে বন্যার বিরুদ্ধে অধিক স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়