চশমা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে বসি নি। চশমা আমাদের অনেকের কাছে অতি আবশ্যিক আবার কারো কাছে অতি প্রিয়। যাদের চোখের দৃষ্টি ‘স্বাভাবিকতা’ হারিয়েছে তাদের কাছে চশমার বিকল্প কল্পনা করা যায় না। অবশ্য আজকাল লেন্স বসিয়েও কাজ সারা যাচ্ছে। আর যাদের দৃষ্টি ‘স্বাভাবিক’ কিন্তু দেখার বাসনা দুরন্ত তাদের কাছে চশমা শখের, রূপের, আভিজাত্যের আর অহংকারের। যাদের ট্যাকে পয়সা নেই অথচ চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে তাদের কাছে চশমার ডাঁটি থাকুক আর না-ই থাকুক, কাঁচ দু’টো থাকুক আর একটাই থাকুক কাজ চালানোর জন্য সেটাই জরুরি। এতো গেলো অপথালমোলজির কথা। আসি বাস্তবে।
আমাদের চোখের পর্দা নষ্ট হয়ে গেছে অথবা ছানি পড়ে দৃষ্টি প্রায়ান্ধ হয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। দিনে দিনে চোখের পাওয়ার কেবলই পরিবর্তিত হচ্ছে। সামনে যা দেখি ঝাপসা লাগে, ঠিককে ‘বেঠিক’ দেখি, দু’য়ে দু’য়ে চারের পরিবর্তে দু’শো দেখে, দু’হাজার পড়ে নিজের কাছেই বিভ্রম জাগে। তাই হিসেব মেলাতে পারি না। কেবলই ধারাপাতের ছন্দে তাল কেটে যায়। ইদানীং অতি পরিচিত পরীক্ষীত মানুষগুলোকেও চিনতে ভারি কষ্ট হয়। তাদের বহুলশ্রুত অমিয় বচনে পচনের গন্ধ পাই, পরম শ্রদ্ধাভাজনেষুদের চিরচেনা পাশা খেলায় কেমন যেন অদ্ভুত অদ্ভুত চাল দেখতে পাই। যার যেখানে থাকার কথা না তাকে সেখানে উপবিষ্ট দেখে বা ক্ষমতা বলয়ের ধারেকাছে আস্থাভাজন হিসেবে ঘুরঘুর করতে দেখে ভাবি গেছে-চোখ গেছে। এবার কাঁচ পাল্টাতেই হবে বোধহয়। আর যাদেরকে যেখানে যে আসনে দেখতে কামনা করি সেখানে তারা নেই। তারা আছে নির্বাক হয়ে, শূন্যদৃষ্টি নিয়ে গৃহকোণে গৃহপালিত দ্বিপদী হিসেবে।
একটা সময় ছিলো যখন শিক্ষকের ওজন ছিলো কিন্তু পয়সা ছিলো না। তবে সম্মান ছিলো। তাই তাদেরকে ইচ্ছেমত কব্জা করা যেত না। অর্থনীতির ধারাপাতে তারা চালাক ছিলেন না। বুদ্ধিমান হলেও ওসবে খুব একটা গা করতেন না। সুশীল ও সংস্কৃতিমনা বলে এক শ্রেণীর লোক ছিলো সৃজনশীলতাই যাদের কাছে ছিলো মুখ্য, পদ-পদবী ছিলো গৌণ। বৈশ্বিক ঢেউয়ে, দৈশিক কালচারে তাদেরকেও দেখি থলে হাতে সুগন্ধি মেখে কর্তৃপক্ষের দ্বারে দ্বারে ফেরি করে বেড়াতে। কমপিটিশনের মার্কেটে সবখানেই ভিড়ভাট্টা বেশি। এতদিন যারা কথা বলতেন নিজস্ব সিলেবাস ধরে, মেপে মেপে, ভারি চালে আজ তাদেরকেই দেখছি প্রভুর কৃপা ধন্য হতে মিউজিক্যাল স্টাফ নোট চেঞ্জ করে কোরাস গাচ্ছে উচ্চস্বরে। কেউ কেউ নতুন ড্রামা রচনায় পেরেশান। টক শো তে বসে তাদের সেকি বিশ্লেষণ, সেকি আস্ফালন! এ হয়ত আমার দৃষ্টির ভ্রম, শ্রুতির অসারতা আর স্মৃতির বিস্মৃতি।
আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করি এগুলো এমন এলোমেলো দেখছি কেন? সব কিছু গোলমেলে লাগছে কেন? স্বজনেরা হাসে, ফোঁড়ন কাটে, মসকরাও করে বুঝি। বলে পুরোনো কাঁচে আর কত? এবার এত দেখাদেখি, শোনাশুনি বাদ দাও। নিজ গৃহে থিতু হও, মসজিদে সময় দাও, মাঝেমধ্যে সরকারি গোরস্তানটা একটু দেখে এসো। সেখানেও পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক। সারি সারি কবরের পাশ দিয়ে কংক্রিটের ওয়াক ওয়ে হয়েছে, কিছুদূর পরপর নিওন বাতি লেগেছে। পারলে কর্পোরেশনে গিয়ে নিজের সাড়ে তিন হাতের বুকিংটা দিয়ে রেখো। স্বজনদের এসব কথা শুনে হাসি, মজা পাই। নিছক তামাসা ভেবে বলি, আমি তো সব ঝাপসা দেখছি।
কে কবে বলে গিয়েছিলো রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এদেশে সেটারই যে এত সুন্দর চর্চা হবে ভাবতে পারিনি। যে যার মত করে বলে যাচ্ছে। কারো সাথে কারো কোন মিল নেই। যেখানে যে সমীকরণ যুতসই মনে হয় সেখানে সেভাবে বয়ান তৈরি হচ্ছে। কাল যে ছিলো হায়ানা সদৃশ আজ তার জন্য কৌশলে ইনিয়ে বিনিয়ে উৎসর্গিত হচ্ছে ইঙ্গিতবাহী মায়াময় কত নীতি কথা! এতকাল যা ছিলো জুলুম আজ তা যেন নিপাতনে সিদ্ধ, বিস্মৃত অতীত। যে যেমন পারছে কামাচ্ছে, কোপাচ্ছে, নামাচ্ছে, ওঠাচ্ছে, ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। গগণভেদি শ্লোগানে কাউকে তাড়া করছে, কারো উপর চড়াও হচ্ছে। কাউকে ধমকাচ্ছে, কাউকে ভয় দেখিয়ে ফায়দা লুটছে। আইনের কথা বলে আইন ভাঙ্গার খেলাও হচ্ছে। কোন কিছুতেই কারো তুষ্টি নেই। সবার রয়েছে কমন এক শ্লোগান, দাবী আদায়ের এক শ্লোগান, “দিবি, নয়তো যাবি”।
অবৈধ দখলদাদের চোটপাট বেজায়। রাস্তায়, রেস্তোরাঁয়, হাটে-ঘাটে-মাঠে যে তোলা তুলে বেড়ায় তার চলন বলন গ্যাংস্টারের মত। রাস্তায় যে চুরি, চামারি, ছিনতাই ইত্যাদি করে বেড়ায় তারও গলায় মানবাধিকারের বুলি। তারপক্ষেও লোকজন আছে। কোন কারণে থানা-পুলিশ, জেল-হাজত- হেনস্তা হলে ছাড়িয়ে আনার, ছিনিয়ে নেওয়ার লোকের অভাব নেই। কিভাবে তারা জেল থেকে বের হয়, কারা তাদেরকে বের করার হুকুম দেয় বয়সী চোখে তাদের মুখাবয়ব দেখা যায় না। তবে তারা যে মানুষরূপী ভয়ংকর সুন্দর হোমোস্যাপিয়েন্স তা টের পাই। তাই আঁতকে উঠি।
ধর্ষণের মাত্রা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। অপরাধীরা ধরা পড়ছে। পিটুনি খাচ্ছে। অথবা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আড়ালে আবডালে তাদের সাথে বিচারের নামে বাটোয়ারা শেষে আপোষ রফা হয়ে যাচ্ছে। যারা হাতেনাতে কট হচ্ছে কেবল তাদের ভাগ্যেই নগদ ধোলাই যা হওয়ার হচ্ছে। আইন আদালতে গিয়ে শেষমেশ কী হয় কেউ তা জানে না। সমাজে অনাচারের সংস্কৃতি দাপটের সাথে রাজত্ব করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মায়াকান্না করা লোকের অভাব নেই। যেন তারা ভিনগ্রহের। যে যার মত যাকে ইচ্ছে খুশি দালাল, এজেন্ট, খুনী, লম্পট, ধর্মব্যবসায়ী, দেশদ্রোহী ট্যাগ লাগিয়ে নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করছে। বিচিত্র সব স্কুপ নিউজের ভাইরাল ব্যবসা করে ইউটিউবাররা দিব্যি ভালো আছে। রাতারাতি গুজবের ফ্যাক্টরির অঙ্কুরোদগম হচ্ছে। ডাহা মিথ্যার বেসাতি বেড়েই চলেছে। পাল্টাপাল্টি কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি, মারামারি, দলাদলি, খুনাখুনি তো চলছেই। মিডিয়া তার ন্যাড়া মাথা নিয়ে আগের ধাঁচেই আপন কাজ করে যাচ্ছে। তারাও জানে জনগণের কাছে তাদের এক পয়সার দাম নেই, আছে প্রবল ঘৃণা ও রসালো উক্তি। মনে হচ্ছে এতে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা তাদের প্রণীত সিলেবাস ধরেই হাডুডু খেলে যাচ্ছে। যাকে পাচ্ছে তাকেই ছুচ্ছে। সি-িকেট সি-িকেট করে গেলো রেজিমে যে এত শোরগোল ছিলো তারা আজও আড়ালে, আবডালে হায়ার ম্যাথের কল্যাণে নিরাপদে খেলারাম হয়ে খেলে যাচ্ছে। পরিবর্তনের মধ্যে আগের আলিগার্কে নতুন আশায় নতুন অংশীজন যুক্ত হয়েছে মাত্র। তাই সি-িকেট আজ মাল্টি ভিটামিনের মত নিরবে নিভৃতে নিজেদেরকে নতুন রূপে সাজাচ্ছে।
সরকারি আধিকারিকরা প্রথমে কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেও এখন তারা পুরোনো সুর নতুন অর্কেস্ট্রায় তুলে নেওয়ার অভিনয় করছে। খালি পুলিশের সেই চেনা অবয়ব দেখা যাচ্ছে না। কখনো তাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত মনে হচ্ছে, কখনো লাজরাঙা বধুর মত ঘোমটা প্রিয় হয়ে থাকতে চাচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে কখনো কারো কামব্যাকের মধুর স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। কবে আসবে সোনালী সেসব দিন আবার? তাদের অনেকেই আজো ট্রমাক্রান্ত। ভাবছি, আগের সে আইন আছে, লাঠি আছে, অস্ত্র আছে,আটকের আর তদন্তের ক্ষমতা সবই আছে। তারপরেও তাদের যেন কী নেই! অথচ এই মাত্র নয়-দশ মাস আগেও তাদের সে কি দক্ষতা ছিলো, কত হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা ও বহুমুখী কৌশল ছিলো! চেয়ে চেয়ে দেখি আর ভাবি দৃষ্টির ক্ষিপ্রতা কমে গেছে বলেই মনে হয় সব কিছু এখন এরূপ উল্টোপাল্টা দেখি।
একদল লোক উঠে পড়ে লেগেছে ‘আগেরটাই ভালো ছিলো’ থিম সং পপুলার করতে। আগেরটা যেন কিরূপ ছিলো? এর চেয়ে ভালো ছিলো কি? তাদের ভাষ্যমতে, বেশ সরেস ছিলো, ভাগেযোগে চেটেপুটে আগাপাশ তল বেশ খাওয়া যেত। হাতে আর ভল্টে কাড়িকাড়ি টাকা থাকত। পরের ধনে পোদ্দারি করে চলা যেত। শাসিয়ে, শাসন করে, গুম, খুন, জখম করে আইনশৃঙ্খলাও মন্দ কী ছিলো? পুলিশের দাপট ছিলো, ঘাড় ধরে তাদের দিয়ে এন্তার কাজ করিয়ে নেওয়া যেত।
ব্যবসায়ীরা তেল চকচকে ছিলো। তারা দুধেল কামধেনুও ছিলো। রাজনীতি একচোখা ছিলো। কিছু ছাল ওঠা সারমেয় সারাক্ষণ ক্ষমতার চারপাশে ঘুরঘুর করত। নাম সর্বস্ব কিছু প্রগতির ধ্বজাধারী নষ্ট-ভ্রষ্ট বিপ্লবী সফেদ পায়জামা পাঞ্জাবী পড়ে “দুনিয়ার মজদুর এক হও” বলে শ্লোগান দিত। এখনো নির্লজ্জের মত দিচ্ছে। অথচ তাদের আর মজুরদের মধ্যে কোন দেখাসাক্ষাৎ নেই, ডায়ালগ নেই, উঠাবসা নেই। তারা সরকারি অফিসে আর ভবনে লাঞ্চ আর ডিনার করে বেড়ায়। তাদের সাথে কোলকাতা হারবালের গুণে বীর্যবান কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের দেখি সারাক্ষণ প্রভুর ভজন কীর্তন গাঁথা রচনা করতে। তখন মিডিয়ার স্বঘোষিত এমিরিটাসরা স্ক্রিপ্টেড প্রশ্ন করত আর প্রেস্ক্রাইবড নিউজ ছাপত, মূল নিউজ চেপে যেত। এসব চিত্র ভাবতেও সত্যি মধুর লাগে। ওল্ড ইজ গোল্ড। বাংগালীর কাছে অতীত সততই মধুর। তাই আগেরটাই ভালো ছিলো আওয়াজ ক্রমশঃই চাউর করছে। এরূপ আসক্তি থেকে আমাদের মুক্তি কবে জানি না। কারা যেন মিলে ঝিলে আবার মজমা জমানোর পাঁয়তারা করছে।
পরিবর্তনের যে সুবর্ণ রেখা দেখা দিয়েছে কারা যেন মিলেমিশে তাতে কালিমা লেপনে ব্যস্ত। কারা যেন ভেতর থেকে ঘুণ পোকার মত কুঁরেকুঁরে খাচ্ছে সারবত্তা। তাদের চেনা চেনা লাগে কিন্তু ঠিকমত যেন চিনতে পারছিনা। তারা ম্যারাডোনার মত হাত, পা, শরীর আর ডিগবাজী দিয়ে গোল করতে বেজায় পটু। মনে হয় এসবই আমার বুড়োকালের জ্যোতিভ্রম আর মতিভ্রম।
লেখক: কলামিস্ট