Friday 06 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: ধর্মীয় শিক্ষা, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

নাঈমা সুলতানা
৬ জুন ২০২৫ ১৮:৪৯

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যা শিক্ষা দেয় প্রতিপালকের আনুগত্য, মানবিকতা, পরিবেশ-সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যবিধির। ইসলামে কুরবানি শুধু পশু জবাইয়ের নাম নয়, এটি আত্মত্যাগ, সহযোগিতা ও পরিশুদ্ধির প্রতীক। কিন্তু এর সঙ্গেই যদি অপচয়, দুর্গন্ধ, রোগ ও পরিবেশ দূষণ যুক্ত হয়, তবে তা ইসলামি চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়।

কুরবানির বর্জ্যে পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি: বাস্তবতা এবং পরিসংখ্যান

বাংলাদেশের নগর এলাকাগুলোতে ঈদ-উল-আজহার সময় পশু জবাইয়ের ফলে প্রায় ১২,০০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয় (সূত্র: DCC Waste Report, 2023)। এর মধ্যে রয়েছে- হাড়, চামড়া, রক্ত, চর্বি ও না খাওয়া মাংস, কসাই স্থান ও নিকটবর্তী ড্রেনে জমে থাকা বর্জ্য এবং রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক ও পলিথিন।

বিজ্ঞাপন

ঈদের সময় বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে একটি ‘শহুরে পরিবেশ বিপর্যয়’ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কেননা, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বর্জ্য না সরালে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মশা বৃদ্ধি পায়।জলাবদ্ধ রাস্তায় মানুষ চলাচল করতে না পেরে স্বাস্থ্য ও কর্মঘণ্টা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

পরিণামস্বরুপ _

পানিদূষণ: শহরের ড্রেন ও খাল গুলোতে রক্ত ও চর্বি জমে গিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
বায়ুদূষণ: পচনশীল বর্জ্যের দুর্গন্ধ ও মিথেন গ্যাস উৎপাদন হয়।
রোগ বিস্তার: WHO-এর মতে,এই মৌসুমে টাইফয়েড, হেপাটাইটিস-A এবং চর্মরোগের হার বেড়ে যায় ৩৭%।
হয়। সর্বোপরি,নগরবাসীর মধ্যে পরিবেশ বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে নাগরিক অসচেতনতা বাড়ায়।

কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ

১. বর্জ্য জবাইস্থলেই ফেলা: নির্ধারিত কুরবানির স্থান থাকার পরেও ৭০%-এর বেশি পশু জবাই হয় বাড়ির সামনে, খোলা রাস্তায় বা নর্দমার পাশে। এতে করে রক্ত, চর্বি, নাড়িভুঁড়ি, পশু দেহাংশ পচে গিয়ে তৈরি করে দুর্গন্ধ, রোগজীবাণু ও পানিদূষণ।

২. পরিষ্কার পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা: সিটি কর্পোরেশনগুলো ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে বর্জ্য অপসারণ’ লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও বাস্তবে তা প্রায়ই সম্ভব হয় না। ফলে ঈদের সময় এবং তার পরবর্তী কয়েকদিন ভুগতে হয় ভয়াবহ পরিবেশ দূষণে।

৩. বৃষ্টির সাথে বর্জ্য নদীতে প্রবাহিত: বর্ষাকাল হলে এই বর্জ্য সরাসরি খাল, ড্রেন, লেক হয়ে চলে যায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, ধলেশ্বরীর মতো বড় নদীগুলোতে যা নদীর পানিদূষণ ঘটায় এবং BOD ও COD মাত্রা অনেকগুণ বাড়িয়ে তোলে।

ট্যানারি শিল্প বনাম পরিবেশ: সম্পদ না অপচয়?

বাংলাদেশে চামড়াজাত পণ্যের বার্ষিক রপ্তানি আয় প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (EPB, 2022)। ঈদের সময়েই প্রায় ৬৫-৭০% কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়। এ মৌসুমে সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের চামড়া শিল্প বছরে প্রায় ৩৫ কোটি ডলার রপ্তানি আয় করে। দেশের চামড়াজাত শিল্পে কর্মরত প্রায় ২ লাখ শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর ওপর নির্ভরশীল। একটি সমীক্ষা মতে, শুধুমাত্র সঠিক সংরক্ষণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করলে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পে অতিরিক্ত ১৫০ মিলিয়ন ডলার আয় সম্ভব।

কিন্তু সঠিক সংরক্ষণ (Preservation) না থাকায় প্রতি বছর প্রায় ২৫ লক্ষ চামড়া নষ্ট হয়। গ্রামের হাটে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে লবণ সংকট,উন্নত প্রসেসিং প্ল্যান্ট ও সংরক্ষণের অভাবে চামড়ার মান নষ্ট হয়। উদাহরণস্বরুপ, হেমায়েতপুরের ট্যানারি জোনে এখনো অনেক ট্যানারির ETP (Effluent Treatment Plant) আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে অকেজো।

এছাড়াও, এর পরিবেশগত বিপদ ও রয়েছে। যেমন –
সাভার ট্যানারি পল্লীতে প্রতিদিন প্রায় ২২,০০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়। অধিকাংশ কারখানার ইটিপি (Effluent Treatment Plant) থাকলেও তা যথাযথভাবে পরিচালিত হয় না। ফলে ক্রোমিয়াম, সালফেট, এসিড জাতীয় বিষাক্ত পদার্থ ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়ে।যা জলজ ইকোসিস্টেম ধ্বংসের জন্য দায়ী। এমনকি মানব স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে : ক্রোমিয়াম-৬ (Hexavalent Chromium) মানবদেহে প্রবেশ করলে ক্যান্সার, স্নায়ুবিক সমস্যা ও হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে স্কিন ডিজিজ, শ্বাসকষ্ট ও জটিল পানি-জনিত রোগের হার ক্রমাগত বাড়ছে।

নীতিগত সীমাবদ্ধতা

জাতীয় পরিবেশ নীতিতে কুরবানিকেন্দ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা নেই।এমনকি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়হীনতা এবং বাজেট ঘাটতির কারণে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয় না। এছাড়াও ট্যানারি বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং দুর্বল, শাস্তির বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। উন্নত দেশগুলো কুরবানির সময় বর্জ্য পরিমাণের রিয়েলটাইম হিসাব ও স্যাটেলাইট ম্যাপ ব্যবহার করে পরিষ্কারের রুটিন অনুসরণ করে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের বর্জ্য GIS ম্যাপিং বা ডেটা-ড্রিভেন মডেল গড়ে ওঠেনি। যা কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে ক্রমাগত কঠিন করে তুলেছে।

করণীয়: টেকসই কুরবানি ব্যবস্থাপনার কৌশলসমূহ _

১. কুরবানি সুনির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ: প্রতিটি ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট, দূষণমুক্ত – স্যানিটাইজড কুরবানি জোন চালু করতে হবে।
কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক Local Environmental Emergency Protocol (LEEP) তৈরি করা।

২. জনসচেতনতা সৃষ্টি: বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব প্রচার করতে হবে। ইমাম, শিক্ষক, স্কাউট ও স্থানীয় ভলেন্টিয়ারদের দ্বারা প্রচারণা চালাতে হবে।

৩. মোবাইল অ্যাপ সুবিধা চালু করা সমীচীন: বর্জ্য অপসারণ, ট্র্যাকিং ও অভিযোগ ব্যবস্থার জন্য অ্যাপ চালু করা যেতে পারে।

৪. নির্দিষ্ট চামড়া সংরক্ষণ পয়েন্ট: প্রত্যন্ত অঞ্চলে অস্থায়ী সংরক্ষণ ও লবণ সরবরাহ কেন্দ্র স্থাপনে মনোযোগ দিতে হবে।

৫. ট্যানারি তদারকি: ETP কার্যকারিতা মনিটরিং ও পরিবেশ সুরক্ষায় অনুমোদন ছাড়া প্রক্রিয়াজাত নিষিদ্ধ করা জরুরি। ট্যানারি বর্জ্য ছাড়ে কঠোর পরিবেশ জরিমানা ও লাইসেন্স স্থগিত করার বিধান প্রয়োগ করা উচিত।

৬. গবেষণা ও ডেটা সংগ্রহ: বর্জ্য পরিমাণ, সংরক্ষণ হার,প্রসেসিং এমনকি রোগ বিস্তার ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হবে।

মোটকথা, নগর-পরিকল্পনায় কুরবানির অন্তর্ভুক্তি,বিজ্ঞানসম্মত চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ,সচেতনতা ও ধর্মীয় অনুষঙ্গের ব্যবহার এবং নীতিগত ও আইনি কাঠামো সংস্কারের মাধ্যমে কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহজতর করা সম্ভব।

পরিবেশ সুরক্ষায় সচেষ্ট থাকা হলো এক ধরনের মৌন ইবাদত – পরিবেশের যত্ন না নিলে সেটি অভিশাপে রূপ নেয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের উচিত কুরবানিকে ধর্মীয় ইবাদতের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব সামাজিক উদ্‌যাপন হিসেবে গড়ে তোলা। কুরবানির সময়ও আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে পরিবেশের প্রতি, স্বাস্থ্যের প্রতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি। পবিত্র ঈদ-উল- আজহায় এভাবেই ধর্ম, বিজ্ঞান ও সচেতনতা এই তিনের সমন্বয়েই আমরা গড়ে তুলতে পারি পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত ও টেকসই বাংলাদেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

কুরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নাঈমা সুলতানা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আজ পবিত্র ঈদুল আজহা
৭ জুন ২০২৫ ০০:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর