ঈদের কোরবানি শেষ হলে রক্ত-মাংসের গন্ধে যখন বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, তখন কারও নজর থাকে গরীবের মুখে হাঁসি ফোটানোর দিকে, আবার কারও নজর থাকে গরুর চামড়ার দিকেই। কেউ চামড়া দান করেন মাদরাসা বা এতিমখানায়, কেউ বিক্রি করে কিছু অর্থ দরিদ্রদের সহায়তায় দেন। আর এবারের ঈদে এমন একজন মানুষ পাওয়া গেছে, যিনি ক্ষোভ আর হতাশা থেকে চামড়া বিক্রিই করেননি—বরং প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গরম পানিতে ধুয়ে গরুর চামড়া রান্না করে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও তিনি আগে কখনো চামড়া খাননি। কিন্তু এই কাজটা ছিল নিছক খাদ্য নয়, ছিল একটি প্রতিবাদী প্রতীক—একটি পচন ধরা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নীরব কিন্তু গভীর উচ্চারণ।
আমার পাড়ায় প্রায় সব চামড়াই বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়, কেউ কেউ পেয়েছেন মাত্র ১৫০ টাকা। অথচ ঈদের আগেই সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়া ৫০-৫৫ টাকা, ঢাকার বাইরে ৪৫-৪৮ টাকা। তাহলে প্রশ্ন হলো, ‘এই দামের ভেলকি কোথায় গেল?’
চামড়া শিল্প: সম্ভাবনার শ্বাসরোধ
এক সময় বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের অন্যতম চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারক দেশ। স্বাধীনতার পর থেকে এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কোরবানির ঈদ এই শিল্পের জন্য প্রধান কাঁচামাল সরবরাহের উৎস, যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৫০-৬০ লক্ষ পশুর চামড়া সংগ্রহ হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শিল্প এখন ভুগছে অব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির কারণে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে বাংলাদেশ আয় করেছিল প্রায় ৯৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরপর রপ্তানি আয় ক্রমান্বয়ে কমে ২০২১-২২ সালে দাঁড়ায় ৭৮৪ মিলিয়নে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও আয় ছিল আনুমানিক ৯২৫ মিলিয়ন ডলার, তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পূর্বের ধারা অনুযায়ী আবার কমে ৮৫০-৮৭০ মিলিয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে বলে প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যায়।
এই হ্রাসশীল প্রবণতার প্রধান কারণ হচ্ছে, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, বাজারে কৃত্রিম দরপতন, চামড়া সংরক্ষণের অব্যবস্থা এবং নীতিনির্ধারকদের নজরদারির অভাব। সরকার প্রতি ঈদেই চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও, মাঠপর্যায়ে এর বাস্তব প্রয়োগ প্রায় অনুপস্থিত। ফলে গরীব মানুষের কোরবানির চামড়া আজ মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত—যা একসময় হাজারো মানুষের জীবিকা ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস ছিল—আজ তা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পথে।
সিন্ডিকেটের খেলা
প্রতি কোরবানির ঈদের সময় একটি সুসংগঠিত চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা মাঠে দালাল ছড়িয়ে দিয়ে কৃত্রিমভাবে দাম কমিয়ে ফেলে, অযৌক্তিকভাবে চামড়া কেনা বন্ধ রাখে, এমনকি চামড়ায় লবণ না দিয়ে পচিয়ে ফেলার অপচেষ্টাও করে। কেউ কেউ আবার কম দামে জোর করে চামড়া কিনে নেয় কিংবা দান করা চামড়ার গাড়ি আটকে দেয়, নানা ভয়ভীতি দেখায়। কৌশলে তারা এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যেখানে দাতব্য প্রতিষ্ঠানেরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে, ক্ষুদ্র বিক্রেতারা চরম ক্ষতির মুখে পড়ে এবং দরিদ্র কোরবানিদাতারা হতাশ হয়ে পড়ে।
মাঠজুড়ে তখন ভেসে বেড়ায় ‘দাম নাই, দাম নাই’—এই শব্দ। দরজার পাশে পড়ে থাকা চামড়া হয়ে ওঠে উপেক্ষিত এক বর্জ্য, যার আর কোনো মূল্য নেই। অনেকে ক্ষোভে কিংবা নিরুপায় হয়ে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেন, ড্রেনে ফেলে দেন বা নদীর জলে ভাসিয়ে দেন। একটি সম্ভাবনাময় শিল্প এইভাবে চক্রবদ্ধ কারসাজির ফাঁদে পড়ে মূল্য হারায়। যে শিল্প একসময় ছিল জাতীয় অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত, সেই শিল্প আজ পড়ে আছে দুর্নীতির ধুলোয় ধূসর হয়ে। মূল্য নির্ধারণ থাকে কাগজে-কলমে, বাস্তবে বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় চক্রান্তকারীদের হাতে। আর সরকার ও প্রশাসন তখন নির্বিকার দর্শকের ভূমিকায়—কখনো নীরব, কখনো দায়সারা।
কেন এই অবস্থার সৃষ্টি?
ট্যানারি স্থানান্তরের জটিলতা: হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের পর প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও পরিবেশগত প্রস্তুতি ছাড়াই কারখানা চালু হওয়ায় উৎপাদনে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।
মূলধনের সংকট: ঈদের সময় বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া কেনার মতো অর্থ অনেক আড়তদারের হাতেই থাকে না। ফলে তারা বাজারে সক্রিয় থাকতে পারে না।
সরকারি নজরদারির অভাব: সরকার প্রতি বছর চামড়ার দাম নির্ধারণ করলেও মাঠপর্যায়ে তার কোনো বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় না। ফলে সিন্ডিকেটেরাই দামের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে।
সংরক্ষণের অভাব: উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নেই প্রয়োজনীয় লবণাক্তকরণ কেন্দ্র বা ফ্রিজিং সুবিধা, যার ফলে অনেক চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না।
পরিবহন ও সংযোগ সমস্যাও চরম: দূরবর্তী অঞ্চল থেকে সময়মতো চামড়া পৌছাতে না পারায় তার গুণগত মান দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, ফলে রপ্তানিযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।
সব মিলিয়ে একটি সম্ভাবনাময় শিল্প কেবলমাত্র পরিকল্পনার অভাব, দুর্নীতির বিস্তার ও মাঠপর্যায়ে নজরদারির ঘাটতির কারণে ধ্বংসের মুখে পড়ছে।
এক লোকের প্রতিবাদ, আমাদের চোখ খুলে দেয়
চামড়া রান্না করে খাওয়ার সিদ্ধান্তটা শুনতে যেমন চমকপ্রদ, এর পেছনের বাস্তবতা ততটাই মর্মস্পর্শী। এটা নিছক কৌতুক নয়, পাগলামি নয়—এটা এক চরম বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক সাদামাটা মানুষের নীরব অথচ শক্তিশালী প্রতিবাদ। যখন বারবার অবহেলা আর অবজ্ঞায় চামড়ার কোনো মূল্য থাকে না, যখন দরিদ্র কোরবানিদাতার চোখের সামনে তার দেওয়া চামড়া পড়ে থাকে ধুলো-মাটিতে, তখন কেউ কেউ মুখ বুজে সহ্য করে, আর কেউ কেউ এই ব্যক্তির মতো প্রতিবাদের পথ বেছে নেয়।
চামড়া রান্না করে খাওয়ার এই ঘটনা যেমন হাস্যকর মনে হতে পারে, তেমনি তা আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়ে যায়। আমাদের ব্যর্থ নীতিমালা, নিষ্ক্রিয় প্রশাসন আর লোভী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এ এক প্রতীকী অথচ শাণিত প্রতিবাদ। এ এক তীব্র প্রশ্নবাণ—এই সমাজে কতবার অবহেলার শিকার হলে, কতটা মূল্যহীন হলে একজন মানুষ এমন অসম্ভব পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন? এই একক প্রতিবাদ আসলে হাজারো মানুষের হৃদয়ের কষ্ট, নীরব কান্না আর চাপা ক্ষোভের একটি রূপ। এটা আমাদের চোখ খুলে দেয়, দেখিয়ে দেয়—কীভাবে একটি সম্ভাবনাময় শিল্পকে আমরা নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলছি, আর সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের আশা-ভরসা।
চামড়া শিল্পের জাগরণ-রূপরেখা
সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন: উপজেলা পর্যায়ে চামড়া সংগ্রহ কেন্দ্র চালু করা: যাতে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাঁচা চামড়া ন্যায্য দামে সংগ্রহ করা যায় এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা বাদ পড়ে।
মোবাইল কোর্ট চালু: মাঠপর্যায়ে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য মোবাইল কোর্ট কার্যক্রম জোরদার করা: সিন্ডিকেট বা দালালদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে এই ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
সহজ ঋণ সুবিধা: আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান: মূলধনের সংকট নিরসনে স্বল্প সুদের ঋণ ব্যবস্থা চালু করা জরুরি, যাতে ঈদের মৌসুমে তারা সরাসরি চামড়া সংগ্রহে অংশ নিতে পারেন।
সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা: চামড়া সংরক্ষণের জন্য লবণ ও হিমাগার সরবরাহ নিশ্চিত করা: অনেক সময় সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে মূল্যবান কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য উপজেলা পর্যায়ে লবণ ও হিমাগার কেন্দ্র স্থাপন অপরিহার্য।
মূল্য প্রচার জোরদার: সরকারি নির্ধারিত দাম প্রচারে গণমাধ্যম ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ: ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় পক্ষকে সচেতন করতেই এই প্রচার কার্যক্রম বাড়ানো দরকার।
সরাসরি সংগ্রহ উদ্যোগ: মসজিদ-মাদরাসা ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে সরাসরি সংগ্রহ ও বিক্রির ব্যবস্থা গড়ে তোলা: এতে দালালদের ভূমিকা হ্রাস পাবে এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যায্য মূল্যে উপকৃত হবে।
সিন্ডিকেট দমন: সিন্ডিকেটে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। বারবার একই অপরাধকারীদের আইনের আওতায় না আনলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।
চামড়ার দামে মর্যাদার প্রশ্ন
বাংলাদেশের চামড়া শিল্প এখনো বিশাল সম্ভাবনার অধিকারী। দক্ষ জনশক্তি, পর্যাপ্ত কাঁচামাল ও বিশ্ববাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমরা পিছিয়ে পড়ছি দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও সিন্ডিকেটের কারণে। এই শিল্পটিকে রক্ষা করা শুধু সরকারের নয়, উদ্যোক্তা, নীতিনির্ধারক ও আমাদের সবার দায়িত্ব। প্রতিবছর কোরবানির ঈদের পর রাস্তায় পড়ে থাকা চামড়া, পচে যাওয়া সম্ভাবনা এবং মানুষের মুখে হতাশা—সবই যেন এক গভীর নৈতিক বিপর্যয়ের চিহ্ন।
দরিদ্র মানুষ কোরবানি দেয় অনেক আশা নিয়ে। চামড়ার দামে হয়তো সন্তানের জামা হবে, পড়ালেখার খরচ চলবে বা ঘরে খাবার আসবে। কিন্তু যখন সেই চামড়া কেউ নেয় না, বা নেয় তুচ্ছ দামে, তখন সে শুধু অর্থ নয়, হারায় মর্যাদাও। এটা শুধু একটি শিল্পের সংকট নয়, এটি সমাজের অসহায় মানুষের আত্মমর্যাদার ওপর আঘাত। এ অবস্থা বদলাতে হলে চাই সারা বছর ধরে কার্যকর, স্বচ্ছ ও নৈতিক ব্যবস্থাপনা। চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও রপ্তানির প্রতিটি ধাপে প্রয়োজন জবাবদিহি ও রাষ্ট্রের কঠোর নজরদারি। এই শিল্প রক্ষা করতে না পারলে শুধু অর্থনীতি নয়, মানবিকতা, দরিদ্রের প্রতি দায়বোধ এবং আমাদের বিবেকও ক্ষয়ে যাবে। এখনই ঘুম ভাঙানোর সময়। নইলে আরও কেউ গরম পানিতে চামড়া ধুয়ে রান্না করে খাবে, আর আমরা ছবি তুলে বলব, ‘এটাই বাস্তবতা!’ কিন্তু এই বাস্তবতা বদলানোর দায়িত্বও আমাদেরই।
লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক