Wednesday 11 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তাহারা বসন্তের সাদা কোকিল

আনোয়ার হাকিম
১০ জুন ২০২৫ ১৫:০৬

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছিলাম একটা স্বাধীন ভূ-খণ্ড , লালণ্ডসবুজের পতাকা আর নিজস্ব মুদ্রা। যুদ্ধবিধ্বস্ত, ভঙ্গুরপ্রায় সেই দেশটাকে নিজেদের মত করে পুনর্গঠনের দায়িত্ব বর্তে ছিলো আমাদের উপর। আমরা গণতন্ত্রের নামে, স্বৈরশাসনের নামে, জান্তার নামে যেনতেন গোছের শাসনে বিগত তিপ্পান্ন বছরে কী করেছি তার বিশ্লেষণ হওয়া অতি আবশ্যিক হয়ে পড়েছে। আমরা কাজ করি, সমালোচনা সহ্য করি না। চামচার স্তুতি ভেক জেনেও তাতে অধিকতর মনোনিবেশ করি। বিরুদ্ধ মতবাদ সহ্য করা তো দূরের কথা তাকে কঠোর হাতে দমন করতে বদ্ধপরিকর হই। শুধু দমন করেই ক্ষান্ত হই না, শেকড় সহ উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত অন্য কিছু ভাবি না।

বিজ্ঞাপন

এই তিপ্পান্ন বছরে আমরা সবাই মিলে দেশ জুড়ে জন্ম দিয়েছি কোটি কোটি মানুষ, লক্ষ কোটি টাকার বাজেট, অগণিত রাস্তাঘাট, পুলণ্ডকালভার্ট, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ভার্সিটি। আকাশ ফুঁড়ে উঠিয়েছি সুউচ্চ প্রাসাদ, ধানি জমি নষ্ট করে হাঁকিয়েছি বাংলো টাইপের ডুপ্লেক্স আভিজাত্য। পাশাপাশি রাজধানীর এলিভেটেড এক্সপ্রেস-ওয়ে, মেট্রোরেল, কর্নফুলী টানেল আর পদ্মা সেতু এরই ধারাবাহিক বাস্তবতা। অনেকে এটাকেই উন্নয়নের মডেল বলে অংগুলী নির্দেশ করে থাকে। বিরুদ্ধবাদীরা এগুলোকে গরীবের ঘোড়া রোগ হিসেবে চিহ্নিত করে আন অডিটেড দুর্নীতির টিপ্পনী কাটে। এদেশে কথা বলার লোকের অভাব নেই। অভাব শুধু কাজের কাজীর। অথচ পাজী লোকের কমতি নেই। পরস্পর কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি আর হাডুডু খেলার মধ্য দিয়ে এভাবেই চলেছে আমাদের তেপ্পান্ন বছরের পথ পরিক্রমা। কারো মাঝে পরমত সহিষ্ণুতার লেশমাত্র নেই। তাদের কাছে পারস্পরিক ‘ঐকমত্য’ বা ‘সমঝোতা’ হচ্ছে নিষিদ্ধ শব্দ। রয়েছে জেদাজেদি, জিঘাংসা আর অপরকে অপদস্থ করে নিজেদেরকে গ্লোরিফাই করার উগ্র মানসিকতা।

পোষাকে-আশাকে আমরা সমকালীন বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছি সমান তালে। কাল যে ফ্যাশন নিউইয়র্কে বা লণ্ডনে বা দুবাইয়ের শপিং মলে ঝলমল করছে তা পরের সপ্তাহেই দেশের মফস্বলের সুপার মার্কেটের ডিসপ্লেতে শোভা পাচ্ছে। বৈধ-অবৈধ পথে দক্ষ-অদক্ষ তকমা নিয়ে প্রচুর বাংলাদেশি পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। এতে করে রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমশঃই বাড়ছে। ডলার যেমন ইনফ্লো হচ্ছে তেমনি লুটপাটের হাজার হাজার কোটি টাকা হুণ্ডি মাধ্যমে ডলারের রুপান্তরিত হয়ে বিশ্বের তাবত তাবত ব্যাংকের ভল্টে জমাও পড়ছে। এতে করে আমাদের জীবন যাত্রার পোষাকি জৌলুশ বেড়েছে বৈকি। কিন্তু মানুষ ঝাঁকে ঝাঁকে দেশান্তরি হচ্ছে। জীবনানন্দ দাশ তবু বলেছিলেন,

“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে”

কিন্তু দেশান্তরি হওয়া এইসব জনতা চলে যাচ্ছে কোনপ্রকার পিছুটান না রেখে, না ফেরার সংকল্প নিয়ে। অনেকেই যাচ্ছে পুরো পরিবার নিয়ে। এদেশে আবার কেউ থাকে নাকি? যারা থাকে তারা গরীব, মুর্খ, ক্ষেত টাইপের। তাদের কোন উচ্চাভিলাস নেই, শেয়ালের মত ধুর্ততা নেই, চিতার মত ক্ষিপ্রতা নেই। ইউরোপ-আমেরিকায় দৌড়াবার মত সাহস ও দম কোনটাই নেই।

আর যারা শাটল ফ্লাইটের যাত্রী তারা অতিশয় ঘোড়েল প্রকৃতির। তারা দেশের খনি থেকে শাবল খুঁড়ে সম্পদ লুটে নিয়ে ফিরতি ফ্লাইটে বৈদেশে চলে যায় মৌজ মাস্তির যোগান দিতে। এরা হোয়াইট কলার পিপল। এদের কেউ কেউ অতি উচ্চ শিক্ষিত। তারা হায়ার ম্যাথে অতিশয় পটু। তাদের পুঁজি হলো কেতাদুরস্ত গেট আপ, পদ-পদবী আর কানেকশন। এরা সুইট টকার, মধুর বচনে আশেপাশের পুওর পিপলকে মোহিত করে ফেলে খুব সহজে। এদের চাপা স্টেনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি, তাতে পিচ্ছিল লিভার লাগানো থাকে ইনবিল্ট। তা থেকে সুবচনমালা মৌ মৌ গন্ধসহ রেডিমেড বেরোয়। এদের রয়েছে দেশিণ্ড-দেশি র‌্যাকেট, প্রটেকশন বলয়, রেসকিউ সিণ্ডিকেট। এদের সবার বচন এক, চলাফেরা ও ওঠাবসা এক রূপ, এক ছন্দে, এক পরিমণ্ডলে।

কিছু অর্ধশিক্ষিত, অ-শিক্ষিতও আছে মিলিওনিয়ার ডলার ক্লাবের সহযোগী সদস্য হিসেবে। এরা তাদের এলিট বসদের ক্যাশিয়ার, সোর্স, সাপ্লায়ার। এরা তোলাবাজ, টেণ্ডারবাজ, ভূমিদস্যুর পেটোয়া বাহিনীর ননকমিশণ্ড বরকন্দাজ। তাদেরও এখন চোখ-কানের দৃষ্টি ও শ্রুতির পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে। এরাও এখন সন্তানসন্ততিদের দেশান্তরি করে দিচ্ছে যে কোন প্রকারে। এক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি সবাই একমুখী। হয়ত একই প্লেনে সপরিবারে যাচ্ছে উচ্চপদস্থ বর্তমান বা সাবেক সামরিক-অসামরিক আধিকারিক, কর্পোরেট পাড়ার বিগবস, পিওন, ড্রাইভার, সুইপার, মিটার রীডার, প্রতিষ্ঠিত চাঁদাবাজ, নিয়োগ বানিজ্যের হেভিওয়েট দালাল, কারওয়ান বাজারের তোলাবাজ, অফিস পাড়ার টেণ্ডারবাজ, নদী-নালা-খাল-বিল-ঝিল, বাড়ী-ঘর-দোকানপাট, বাস স্ট্যাণ্ড-টেম্পু স্ট্যান্ড দখলবাজ।

তাদের সাথে হয়ত সহযাত্রী হিসেবে আরো আছে মিডিয়ার ভূঁইফোড় লোকজন, দলীয় ক্যাডার, ব্যবসায়ী টাইকুনরাও। যাচ্ছে হয়ত ইউরোপে, আমেরিকায়, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা কিংবা সুইজারল্যান্ড। হয়ত যাচ্ছে ঈদ ভেকেশনে ঘুরতে, নয়ত উইন্টার উপভোগ করতে নয়ত কোমর ব্যাথার ট্রিটমেন্ট নিতে নয়ত হজ্জ্ব বা উমরা পালন করতে। অথচ যে অর্থের উপর ভর করে এদের এই উত্থান, সে অর্থ লুটপাটের, ছিনতাইয়ের, চাঁদাবাজির, অবৈধ দখলদারির, ভূমিগ্রাসের, অবৈধ নিয়োগের, অবৈধ বখরার, অপহরণ জনিত মুক্তিপণের, প্রকল্পের লুটপাটের, কমিশন বাণিজ্যের। এই কাতারে আছে প্রগতিশীল নামের কচ্ছপ সদৃশ অনেকেই, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যারা খোলসে মুখ ঢুকিয়ে রাখে, কখনো শীতনিদ্রায় থাকে। এসব স্বঘোষিত কমরেডদের সাথে কারো কোন যোগাযোগ নেই। আছে গোলটেবিলে আর প্রাসাদে প্রাসাদে নিশিতে। আরো আছে কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবি শ্রেণী। এরাও কামেল অতিশয়, সুশীলের ছদ্মাবরণে ভাগেযোগের অন্যতম স্ট্যাকহোল্ডার। আছে সুপার এলিট হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিভারাক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় হেভিওয়েট শিক্ষক। কলমের খোঁচায়, বুদ্ধির প্যাচে, মুখের বচনে তারাও আজ ফ্রন্ট লাইনার। এরা প্রকাশ্যে বাকি সুবিধাভোগীদেরকে গালি দেয় কিন্তু নেপথ্যে তাদেরই টেবিলে টেবিলে থলে নিয়ে ঘুরে আর প্রজেক্ট ভিক্ষা করে বেড়ায়। দেশি-বিদেশি ফাণ্ডেড প্রকল্পে চড়া দামের কনসাল্টেন্সি করে ভলিউম ভলিউম যা পেশ করে তা দিয়ে দেশের কী উপকার হয়েছে তা জানার উপায় থাকে না।

তেপ্পান্ন বছর যাবত এইসব হোয়াইট কলার পিপলরাই দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছে। সেই জোয়ারে সরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠান তাদের স্বকীয়তা হারিয়েছে, পঙ্গুপ্রায় এসব প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছে সেবা প্রদানের নামে লুণ্ঠনের কেন্দ্রে, বাছবিচার আর অনাচারের দুর্ভেদ্য দুর্গে আর অনিয়ম-অনাচারের বৈধতা দানকারী প্রতিষ্ঠানে। এরাই মিলিমেশে এগুলো ধংস করেছে নানা উছিলায়। ভাবছেন রাজনীতিবিদদের এসবের উর্ধ্বে রাখার কারণ কি? কারণ অনেক। এদের চাকে ঢিল ছুড়লে জেনারেশনের পর জেনারেশন ভুগতে হবে। পালাবদলের রাজনীতিতে প্রভুহীন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বরাবর প্রাপ্যতাবিহীন অবস্থাতেই থাকতে হবে। হোয়াইট কলার পিপলের সবাই যে তাদের বশংবদ ভৃত্য হয়ে নির্বিঘ্নে কামাই-রোজগার করে খাচ্ছে। ভাসুরের নাম মুখে না নিলেও ক্ষতি নেই। পাবলিক সবকিছু ভালো জানে।

তাই বলে সবাই খারাপ, লম্পট, দুর্বৃত্ত ও লুটেরা? নিশ্চয় না। তবে সিণ্ডিকেটের কাছে এরা শুধু অপাংক্তেয়ই নয় অবাঞ্ছিতও বটে। এদের কোন দল নেই, জোট নেই, ফোরাম নেই। থাকলেও ক্ষুদ্র। এরা মিডিয়া কভারেজ পায় না। এরা মূলতঃ মিতভাষী ও নরম প্রকৃতির। তাই মিডিয়ায় হাইপ তোলার মত না। এরা পোষাক সচেতন না। তাই, হোয়াইট কলার পিওপলের দাপটে এদের কন্ঠস্বর উচ্চ মাত্রা পায় না।

এত গেলো বিগত সময়ের সাতকাহন। এখন সময় ঘুরেছে। পরিবর্তনের সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল হয়েছে। কিন্তু তাতেও দেখা দিয়েছে বিপত্তি। আবারো গিরগিটি সদৃশ সরীসৃপেরা ক্ষণে ক্ষণে রঙ পাল্টাচ্ছে। উদ্ভুত বৈরি পরিস্থিতি সামলে নিয়ে সেই হোয়াইট কলার পিপলেরা আবারো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের কথাবার্তা খুব স্পষ্ট। হঠাৎই তারা আত্মোপলব্ধিতে বলীয়ান হয়ে এখন যথেষ্ট দায়িত্ববান হয়ে উঠেছে। এবার নাকি পরিবর্তনের সব কিছু এদের হাত ধরেই হবে। কে বলে হবে না? নির্মলেন্দু গুণের কবিতার ভাষায় বলি:

“কে কবে বলেছে হবে না? হবে, বউ থেকে হবে।
একদিন আমিও বলেছিঃ ‘ওসবে হবে না’।
বাজে কথা। আজ বলি, হবে, বউ থেকে হবে”।

তেপ্পান্ন বছরে যা সম্ভব হয়নি এবার হবে বলে প্রতিনিয়ত ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। এসব শুনে বেজায় উদ্দীপিত হই। মনের অজান্তেই মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত উঁচুতে উঠে যায়। ভারাক্রান্ত মনে আবার তা পরক্ষণেই নেমে আসে। পরক্ষণেই এসব হোয়াইট কালার কোকিল সদৃশ কুশীলবদের অতীত পারফরম্যান্সের চিত্র ভেসে উঠে। তাই সংশয় নিয়ে ভাবি, হবে তো? আসলেই হবে তো? যা হয়নি তেপ্পান্ন বছরে…

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

আনোয়ার হাকিম বসন্তের সাদা কোকিল মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর