‘আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা’- এই বাক্যটি বাবা দিবসে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে পরিমাণে ঘুরে বেড়ায়, তাতে মনে হয় এ দেশে আর কোনো সন্তানই তার বাবাকে অবহেলা করে না। অথচ বাস্তবতা বলছে, বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে থাকা নিঃসঙ্গ বাবারাই যেন এই সমাজের সবচেয়ে ‘অপ্রয়োজনীয়’ মানুষ।
বাবা দিবস এলে হঠাৎ করে আবেগে ভাসে অনলাইন দুনিয়া। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স-সবখানে বাবাকে নিয়ে স্ট্যাটাস, ছবি, কোলাজ, ভিডিও। কেউ পুরনো দিনের ছবি পোস্ট করছে, কেউ বাবার হাত ধরে হাঁটার গল্প বলছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই পোস্টগুলোর অনেকগুলোই আসছে তাদের কাছ থেকে, যারা বাস্তব জীবনে বাবার খোঁজ রাখে না। এমনকি কেউ কেউ নিজ হাতে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে নিজের বাবা-মাকে, তারাও দিব্যি ক্যাপশন দেয়, ‘বাবা মানেই ছায়া’!
২০২২ সালে বিডি নিউজে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, রংপুরে বৃদ্ধাশ্রমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার বাবার জানাজায়ও অংশ নেয় নি কোনো সন্তান। সেই প্রকৌশলীও কারও ছিলেন কারও জীবনের বটবৃক্ষ।
এই একচোখা সামাজিক আচরণ শুধু লজ্জার নয়, ভয়াবহ। যত্ন না করা, খবর না নেওয়া, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া এসবই যেন ঢাকা পড়ে যায় একদিনের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে। সন্তান হিসেবে সামাজিক ‘ভালো মানুষ’ ইমেজ তৈরির জন্য বাবা দিবস একটি ‘সুবর্ণ সুযোগ’। শুধু ক্যামেরাবন্দি ভালোবাসা আর দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী নির্মিত শ্রেষ্ঠত্বের গল্প।
দেশের বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রম সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, শতকরা ৭০-৮০ ভাগ বাবাকে সন্তানরা বছরের পর বছর দেখতেও আসেন না। কেউ কেউ নিজের পরিচয়ই গোপন রাখেন, বাবা যেন আর ছায়া না হয়ে সমাজে বোঝা না হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বাবা দিবসে সেই মানুষগুলোই হয়তো স্ট্যাটাস দেন ‘বাবা মানেই আশ্রয়’।
প্রতিটি গল্পেই একটি ভালো দিক থাকলে আরেকটি মন্দ দিকও খোঁজে পাওয়া যায়। শুধু অবহেলা নয়, বাবাদের বিরুদ্ধে আসে নানা অপরাধের অভিযোগও। হ্যাঁ, বাবা শব্দটি অনেকের কাছে ভরসা। কিন্তু সেই একই শব্দ অনেক সন্তানের জীবনে ভয়, দুঃসহ স্মৃতি কিংবা এক চিরস্থায়ী ক্ষতের নাম। অনেক মেয়ে শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তার বাবার কাছে। চলতি বছরেই কালের কণ্ঠে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, নেত্রকোণায় বাবা তার ১৫ বছর বয়সী মেয়েকে একাধিকবার ধর্ষণ করে; এমনকি মেয়ে গর্ভবতী হলে গর্ভপাতও ঘটিয়েছেন সেই বাবা। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত আরেক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, ১০ বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে চট্টগ্রামে এক বাবাকে গ্রেফতার করা হয় গত মার্চ মাসে। কেউ হয়তো বলে উঠতে পারে ‘ও তো প্রকৃত বাবা নয়!’ কিন্তু আইনি নথি বলছে, জন্মদাতা তো তিনিই। তাহলে কোন যুক্তিতে আমরা তাকে বাবা-পরিচয় থেকে বিচ্যুত করবো?
একজন সন্তানের কাছে তার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ এই বিশ্বাসই একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলা যায়। কিন্তু সেই বিশ্বাসকে সার্বজনীন করে ফেলাটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমাদের এই একপেশে গ্লোরিফিকেশনই হয়তো সুযোগ করে দেয় কিছু ‘বাবা’র জন্য নীরবে অমানবিক আচরণ করার। কারণ সমাজ আগে থেকেই ধরে নিয়েছে বাবা মানেই ভালো।
এই সমাজে কিছু বাবা আছেন, যারা রাতে কাজ শেষে ক্লান্ত হয়ে ফেরা ছেলেটির স্বপ্নগুলো বুঝতে চান, পাশে থাকেন। আবার এমন বাবাও আছেন, যিনি স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে সন্তানকে যৌন নিপীড়নের শিকার করেন। কারও কাছে বাবা মানে বুক ভরে আকাশ দেখা, কারও কাছে বাবা মানেই একটি তালাবদ্ধ ঘর, ভয় আর লজ্জার গন্ধ।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে জানা গেল, গতকাল শনিবার কামরাঙ্গীরচরে পারিবারিক বিরোধে বাবার ছুরিকাঘাতে ছেলে খুন হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সন্তানকে হত্যার দায়ে বাবার গ্রেফতারের খবর উঠে এসেছে গণমাধ্যমে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে সব বাবাই কি শ্রেষ্ঠ? ‘বাবা’ পরিচয়ের আড়ালে কি আমরা সবাইকে অন্ধ প্রশংসায় ঢেকে দেই? নাকি সময় এসেছে একজন মানুষ হিসেবে বাবাকেও মূল্যায়ন করার?
এটা ঠিক, অধিকাংশ বাবাই নিঃস্বার্থভাবে সন্তানের জন্য জীবন কাটান। দিনশেষে নিজের চাওয়া-পাওয়া বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলেন। কিন্তু এই পবিত্র ছবির পাশাপাশি এমন একটি বাস্তবতা রয়েছে, যা কোনো দিবসের পোস্ট দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না।
সন্তানের দায় শুধু বাবা দিবসে ছবি পোস্টে সীমাবদ্ধ নয়। সেটা একজন মানুষ হিসেবে নিজের পিতা-মাতার প্রতি প্রতিদিনকার দায়িত্ব, যত্ন ও সম্মান। বাবা শ্রেষ্ঠ; হ্যাঁ, কিন্তু সেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় সন্তান যদি তার প্রাপ্য দায়িত্ব পালন করে। আর বাবা যদি দায়িত্বের অপব্যবহার করেন, অপকর্ম করেন তবে তিনিও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন।
সোশ্যাল মিডিয়ার বাহারি শব্দের আড়ালে কিছু সন্তানের নিঃশব্দ কান্না চাপা পড়ে যায়। বাবা দিবসে শুধু ভালো বাবাদের উদযাপন নয়, খারাপ বাবাদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানোও সময়ের দাবি।
তাই বাবা দিবস মানেই একপাক্ষিক আবেগের প্রদর্শনী হওয়া উচিত নয়। বাবা দিবসে আমাদের দরকার একজন প্রকৃত ‘মানবিক অভিভাবক’কে স্বীকৃতি দেওয়া, আর সমাজে ছদ্মবেশী পিতৃত্বের মুখোশটুকু উন্মোচনেরও দায় নেওয়া। বাবা দিবসে শুধু ‘ভালোবাসা’র গল্প নয় উঠে আসুক দায়, প্রশ্ন আর বাস্তবতাও। তবেই এই দিবস তার প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়