Monday 16 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাবাকে নিয়ে না বলা কথা

সুদীপ্ত শামীম
১৫ জুন ২০২৫ ১৮:১০ | আপডেট: ১৬ জুন ২০২৫ ১৬:৪৩

আজ ফাদারস ডে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে ছবি, স্মৃতি আর স্ট্যাটাসের ছড়াছড়ি—সবই বাবাকে নিয়ে। এই একটি দিনে যেন হঠাৎ করে বাবারা আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। অথচ বছরের বাকি ৩৬৪ দিন বাবারা থাকেন নিঃশব্দে, চুপচাপ। তারা কোনো দাবি তোলেন না, কোনো অভিযোগ করেন না। অথচ পরিবারের প্রতিটি ইট, প্রতিটি নিঃশ্বাসের পেছনে বাবার ঘাম আর আত্মত্যাগ লুকিয়ে থাকে।

বাবা শব্দটা এক অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে। এই শব্দটা উচ্চারণ করলেই বুকের ভেতর একটা দৃঢ়তার অনুভব আসে। কিন্তু সেই দৃঢ় মানুষটাকেই আমরা সবচেয়ে কম বলি, ‘তোমাকে ভালোবাসি।’ মা যেমন আমাদের আবেগের কেন্দ্রবিন্দু, বাবা তেমনি আমাদের জীবনের নিরাপত্তাবেষ্টনী।

বিজ্ঞাপন

বাবা মানে ভোরবেলা চুপচাপ ঘুম ভেঙে বাইরে চলে যাওয়া। বাবা মানে দিনের পর দিন নিজের প্রয়োজনগুলো দমন করে সন্তানের প্রয়োজন আগে দেখা। বাবা মানে বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরও চুপিচুপি দরজা ঠিক করে দেওয়া, পাখা গুছিয়ে দেওয়া, ভেতরে এসে চুপ করে বসে থাকা—যেন কোনো কিছুর ভার তাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছেন না।

আমার মতো গ্রামের মানুষদের জীবনে বাবা মানেই ছিলেন সংসারের রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রামের প্রতীক। আমি দেখেছি—আমার বাবা সারা দিন মাঠে কাজ করে ঘরে ফিরে মাটির ঢেলার মতো চুপ হয়ে থাকতেন। তার কোনো অভিযোগ ছিল না। আমাদের একজোড়া জুতা দেওয়ার আগে তিনি নিজের ছেঁড়া জুতা সারাতেন। ঈদের সকালে আমরা যখন নতুন পাঞ্জাবি পরে আনন্দ করতাম, তখন তিনি তার পুরনো লুঙ্গি আর ফাটা শার্টেই মসজিদে যেতেন।

আমার বাবা পড়ালেখা করতে পারেননি, কিন্তু জীবনের বড় শিক্ষাগুলো আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি। সততা, কষ্টসহিষ্ণুতা, আর ধৈর্য—এই তিনটি শব্দের প্রকৃত মানে আমি বাবার জীবনে দেখেছি। আজ এই বয়সে এসে বুঝি—আমার ভিত গড়ে উঠেছে তার আদর্শের ওপর। অথচ কখনো বলা হয়নি, “বাবা, তোমার মতো মানুষ হতে চাই।”

ফাদারস ডে-র দিনে আমরা বাবাকে নিয়ে ভাবি, ছবি পোস্ট করি, হয়তো একটি কল দিই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কতটা সময় তাকে দিই? বাবা হয়তো এখনও দরজার ধারে বসে থাকে, কখন সন্তান ফোন দেবে, কখন দেখা হবে। সন্তান যে ব্যস্ত, এটা বাবা বোঝেন। কিন্তু যে মন ভীষণভাবে অপেক্ষায় থাকে, সেটাও তো একটা হৃদয়।

আজ যারা বাবা হয়ে উঠেছেন, তাদের মধ্যেও অনেকেই বুঝে ফেলেছেন—এই ভূমিকা কতটা কঠিন। সন্তানের মুখে হাসি ধরে রাখতে গিয়ে একজন বাবা প্রতিদিন কত কষ্ট চেপে যান, সেটা শুধু তিনিই জানেন। সমাজ বাবাকে নিয়ে কথা বলে কম, তার মর্যাদা কাগজে-কলমেই থেকে যায় অনেক সময়। অথচ তিনিই তো সেই ব্যক্তি, যিনি নিজের জীবনটাকে একটা সেতু বানিয়ে দেন, যাতে সন্তান সহজে এগিয়ে যেতে পারে।

আজ এই ফাদারস ডে-তে আমাদের শপথ নেওয়া উচিত, বাবাদের ভালোবাসা শুধু একদিনের স্মরণ নয়, বরং প্রতিদিনের দায়িত্ব হয়ে উঠুক। বাবারা যেমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে আমাদের জীবন গড়েন, তেমন আমরা যেন তাদের জীবনের শেষ প্রহরগুলোতে পাশে থাকি—একটু সময়, একটু শ্রদ্ধা, আর একটু যত্ন নিয়ে।

শেষ করতে চাই এক নিঃশব্দ অভিমানের ব্যাখ্যা দিয়ে। অনেক সময় বাবারা কিছু বলেন না, কিন্তু কষ্টে চোখটা লাল হয়ে যায়। আমরা দেখি না, কারণ আমরা খুঁজে দেখি মায়ের চোখে জল, বাবার চোখে কষ্ট নয়। আজ একটু খেয়াল করি, আপনার বাবার চেহারায় বয়সের রেখা, হাতে কষ, চুলে রুপালি ধুলো, সবই একটা যুদ্ধের ইতিহাস বহন করে। সেই যোদ্ধাকে আজ বলুন, ‘আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা, সবটুকু তোমার জন্যই, বাবা।’

লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক

সারাবাংলা/এএসজি

বাবাকে নিয়ে না বলা কথা মুক্তমত সুদীপ্ত শামীম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর