যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানের উপর পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালায়, তাহলে ইরান কি ধ্বংস হয়ে যাবে? কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ইরাকের মতো ইরানও হয়তো সহজেই ভেঙে পড়বে। কিন্তু এই আশঙ্কা বাস্তবের নিরিখে যথেষ্ট দুর্বল। কারণ, ইরানের ভূপ্রকৃতি, সামরিক কাঠামো, কৌশলগত অবস্থান এবং আঞ্চলিক প্রভাব ইরাকের চেয়ে বহু গুণ বেশি বিস্তৃত ও শক্তিশালী।
ইরানের বহু সামরিক ঘাঁটি পাহাড়ি অঞ্চল ও গুহাভিত্তিক, যেগুলো আকাশ থেকে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কোনও বহিঃশক্তি ইরানকে সরাসরি স্থলভিত্তিক আক্রমণে দমন করতে পারবে না। কারণ, ইরান শুধু মিসাইল আর ড্রোনের দেশ নয়, তাদের রয়েছে প্রশিক্ষিত পদাতিক বাহিনী, বিকেন্দ্রীভূত সামরিক কাঠামো এবং জনগণের মধ্যে একধরনের আদর্শিক প্রতিরোধশক্তি।
তবে শুধু ইরানের প্রতিরক্ষা নয়, তাদের প্রতিঘাতের ক্ষমতাও বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয়। তাদের মিসাইল প্রোগ্রাম দিন দিন নিখুঁত এবং দীর্ঘপাল্লার হয়েছে, আর ড্রোন প্রযুক্তি তো এখন রপ্তানিযোগ্য হয়ে উঠেছে—যার বাস্তব উদাহরণ ইউক্রেন যুদ্ধেই দেখা গেছে, যেখানে রাশিয়া ইরানের Shahed সিরিজের ড্রোন ব্যবহার করেছে। এই প্রযুক্তি এখন ইরানের কৌশলগত প্রভাবের অন্যতম ভিত্তি। পাশাপাশি, হিজবুল্লাহ, হুতি, পিএমএফসহ ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক পুরো মধ্যপ্রাচ্যে একধরনের ছায়া-সাম্রাজ্য তৈরি করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, ‘যখন ইরানের কিছু ঘাঁটি আক্রমণের শিকার হয়, তখন কি সেটা ইরানের দুর্বলতা?’ এই প্রশ্নের উত্তর আজকের বিশ্বের আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে পাওয়া যায়—রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে। ইউক্রেন, যাদের সামরিক প্রযুক্তি ও রিসোর্স অনেকটাই পশ্চিমের উপর নির্ভরশীল, তারা ২ হাজার কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে রাশিয়ার পাঁচটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে সফলভাবে ড্রোন হামলা চালিয়েছে এবং ব্যাপক ক্ষতি করেছে। অথচ, রাশিয়া একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও অতি উন্নত। তবুও তারা এই হামলা ঠেকাতে পারেনি। তাহলে যদি পশ্চিমা দুনিয়ার সম্মিলিত টেকনোলজি ব্যবহার করে ইরানের কিছু স্থাপনায় হামলা হয়, তা ইরানের দুর্বলতা বলে ধরে নেওয়া অনায্য হবে। এটা আধুনিক যুদ্ধের বাস্তবতা—এখন কোনো ঘাঁটি শতভাগ নিরাপদ নয়।
এই কারণে ইরানে কিছু হামলা হলে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। বরং এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, ইরান সেই আঘাতের বিপরীতে কিভাবে জবাব দেয়, কতটা কৌশলময়ভাবে তা মোকাবিলা করে এবং কোথায় কোথায় প্রতিক্রিয়া জানায়। এখানে সানজুর ‘The Art of War’-এর কথা স্মরণ করাই যথার্থ—একজন দক্ষ সেনানায়ক সব অস্ত্র একসাথে ছুঁড়ে দেয় না, বরং ধাপে ধাপে প্রতিপক্ষকে ক্লান্ত করে, বিভ্রান্ত করে এবং সময় ও পরিসর বুঝে আঘাত করে। ইরানও সে পথেই এগোচ্ছে।
ইরানের কৌশলগত শক্তি এবং ভূপ্রকৃতি যেমন একটি প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে, তেমনি যুদ্ধনীতির ইতিহাসেও এ রকম ঘটনা বিরল নয়। ইতিহাসে পার্থিয়ানরা রোমান সেনাবাহিনীকে ৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কারাহা যুদ্ধ (Battle of Carrhae) তে পরাজিত করেছিল, যেখানে তারা গরু-চালিত তীরন্দাজ ও ঘুর্ণায়মান কৌশল ব্যবহার করে আধুনিক প্রতিরক্ষার উদাহরণ স্থাপন করেছিল। এটি ছিল একটি ক্লাসিক ‘আবৃত্ত কৌশল’ (encirclement), যা প্রায় দুই শতাব্দী আগে হ্যানিবলের ক্যান্না যুদ্ধ (Battle of Cannae, 216 BCE)-এর কৌশলের মতোই, যেখানে হ্যানিবল তার ছোট বাহিনী দিয়ে রোমানদের বিশাল সেনাকে ঘিরে ফেলে ইতিহাসের অন্যতম সেরা সামরিক কৌশল প্রয়োগ করেছিল। এই দুই যুদ্ধেই দেখা যায় যে, সংখ্যায় বড় শত্রুকে পারদর্শী কৌশল এবং ভূগোলগত সুবিধা দিয়ে পরাস্ত করা সম্ভব।
সব মিলিয়ে, ‘ইরান শেষ হয়ে যাবে’—এই কথাটি কেবল একরৈখিক ভাবনা থেকে উৎসারিত। বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল। যুদ্ধ এখন আর শুধু মাঠে নামার বিষয় নয়, এটি মনস্তত্ত্ব, প্রযুক্তি, ভূপ্রকৃতি, কৌশল এবং সময়ের লড়াই। ইরান সেই লড়াইয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছে বহু দশক ধরে। তাই সাময়িক ক্ষয়ক্ষতি বা লক্ষ্যভ্রষ্ট বিশ্লেষণে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই—ইরান যুদ্ধ বুঝে, যুদ্ধ ধরে, এবং প্রয়োজনে জবাব দেয় তাদের নিজস্ব সময় ও শর্তে।
লেখক: কলামিস্ট