Tuesday 17 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিস্টেম কাজ করে না — উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে

আনোয়ার হাকিম
১৭ জুন ২০২৫ ১৯:৪৯

এদেশে সিস্টেম কাজ করে না। এটা নতুন কিছু না। সিস্টেম অবশ্যই আছে। তবে সিস্টেমের মাধ্যমে কাজ পেতে হলে আগে থেকে ‘সিস্টেম’ করে নিতে হয়। সেই প্রাক সিস্টেমের কারিগর হিসেবে রয়েছে প্রত্যেক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরের কিছু লোক। তাদের দ্বারস্থ হলে আলিবাবার দরোজা চিচিং ফাঁকের মত সিস্টেম মত খুলে যাবে। আর প্রাক সিস্টেম ডিঙ্গিয়ে যদি আপনি সরাসরি সিস্টেমে ঢুকতে চান আপনার গলদঘর্মই সার। সুকতলা শেষ। কাজের কুলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে না। মোটের উপর যা পাওয়া যাবে তা হলো প্রতি পদে পদে ভোগান্তি, দফায় দফায় নতুন নতুন তথ্য ও প্রমাণক দাখিলের নির্দেশ। এত কিছুর পরেও যদি আপনি মেরুদ- সোজা করে ঘাড় ত্যাড়া করে দাঁড়াতে পারেন তাহলে সিস্টেমের বহুলশ্রুত কথামালা শোনা যাবে: সিস্টেম হ্যাং হয়ে গেছে, মেইনটেন্যান্স চলছে, কবে ঠিক হবে বলা যাচ্ছেনা, ফোন দিয়ে আসবেন, সার্ভার ডাউন ইত্যাদি। অথচ ডানে-বামে তাকালে দেখা যাবে সিস্টেম ঠিকই কাজ করছে, প্রাক সিস্টেম উত্তীর্ণরা হাসিমুখে সেবা নিয়ে সরকারি দপ্তর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে প্রশ্ন করলেও উত্তর পাওয়া যাবে না। কপালে থাকলে ঘাড় ধাক্কা মিলতে পারে।

বিজ্ঞাপন

অথচ আজ এত বছর পর এমন তো হওয়ার কথা ছিলো না। প্রশাসনে ডিজিটালাইজেশন হয়েছে আজ প্রায় এক দশকেরও উপরে। অথচ সিস্টেম শৃঙ্খলা মুক্ত হয় নি। সরকারি প্রায় অধিকাংশ সেবাই আজকাল অন লাইনে দেওয়া হচ্ছে। সিস্টেম যারা চালায় আর যারা এর নিয়ন্ত্রক তাদের অসততা, উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা ও উদ্যোগ-উদ্দমের অভাবে সিস্টেমের সুফল জনগণ কাংখিত মাত্রায় পাচ্ছে না। তবে বেশ কয়েকটি সরকারি দপ্তরের কিছু কিছু কাজে অন লাইন সেবার সুফল পাচ্ছে সেবাপ্রত্যাশীরা। দেখা যাবে, সেই সব দপ্তর, সংস্থার কোন এক আধিকারিকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই সেবা সিস্টেম গড়ে উঠেছে। এরকম প্রায় দপ্তরেই কেউ না কেউ হাল ধরে অনলাইন কার্যক্রম চালু করেছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা শুরু করি, শেষ করি না, চালুও রাখি না। একবার হোচট খেলে সেখানেই ক্ষান্ত দেই।

ধারাবাহিক উত্তরসূরী যারা দায়িত্ব নিয়ে শীর্ষ চেয়ারে আসীন হন তাদের আন্তরিকতার উপর নির্ভর করে প্রাক সিস্টেম মুক্ত সিস্টেম চালু থাকা। অনেক আধিকারিক এতে গা করেন না। যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী লোকবল পদায়ন করেন না। পিরিয়ডিক্যাল মনিটরিংয়ের কাজ করেন না। যার ফলে এর সাথে সংশ্লিষ্টরা যাচ্ছেতাই কর্ম করার দু:সাহস দেখায়। যে কোন মূল্যে সরকারি দপ্তর, সংস্থাসমূহে অনলাইন সিস্টেম কার্যকরভাবে চালু রাখতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিতে হবে। পিরিয়ডিক তত্ত্বাবধান কাজ কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। সম্ভাব্য সকল কাজ যেন জনগণ অনলাইনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। যারা গাফিলতি করবে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সিস্টেম সচল রাখতে এর রেগুলার মেইনটেন্যান্স করার ব্যবস্থা ও বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। বর্তমানে চালু এপিএ (বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি) সংশোধন করে অনলাইন কার্যক্রমে কোন দপ্তর কত সংখ্যক সেবা সংযুক্ত করেছে ও হালনাগাদ রাখতে পেরেছে তার ভিত্তিতে দপ্তর সংস্থার পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে হবে। ওপেন ডে বৈঠক ও এর আউটকামও এই মূল্যায়নের মধ্যে নিতে হবে। তাহলেই কেবল সেবাপ্রত্যাশী জনগণ অনলাইনের মাধ্যমে তাদের সেবা সমূহ পাবে। এ কাজটি চ্যালেঞ্জিং তবে কঠিন না। শুধু দরকার উদ্যোগ, উদ্যম, তত্ত্বাবধান আর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা।

আজকাল কেউ কোন দায়িত্ব নিতে চায় না। এমনকি অর্পিত দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করতে অনীহা বা উদাসীনতা প্রকাশ করে। তাদের কাছে ন’টা-পাঁচটা অফিস করাই যেন অনেক। কোন ঘটনা ঘটলে বা উপর থেকে আদিষ্ট হলে সবাই নড়েচড়ে বসে। প্রয়েক্টিভ মানসিকতা খুব কম আধিকারিকের মাঝেই দেখা যায়। সবাই উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এর ফলে গত রেজিমে কোন সিস্টেমই কাজ করে নি। সচিব বলেন মাননীয় মন্ত্রীমহোদয়ের নির্দেশক্রমে তিনি বা তারা এ কর্ম করেছেন। খোদ মন্ত্রীরাও প্রকাশ্যে বলতেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তিনি এই কাজ করেছেন। অথচ কাজটি একান্তভাবেই মন্ত্রণালয়ের। এর ফলে সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়েছে। সবাই নির্দেশনার জন্য যার যার উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এভাবেই সর্বোচ্চ শীর্ষ নির্বাহীর আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করার কারণে সিস্টেম কোন কাজ করে নি। ফলতঃ আমলাতন্ত্র এখন পড়েছে কঠিন বিপদে। তাই যে কোন মূল্যে সিস্টেম যাতে যথাযথভাবে কাজ করে তার ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে উপরের আকাশ দেখতে দেখতে ঘাড় আর চোখের বারোটা বাজবে, কালক্ষেপণ করতে করতে সমস্যা আরো প্রকট হবে কিন্তু প্রতিশ্রুত সেবা সহায়তার নির্যাস সেবা প্রত্যাশীদের কাছে গিয়ে পৌছবে না।

আবার সিস্টেম থাকলেও তার কারিগরদের কঠিন জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে না পারলেও কোন লাভ নেই। কঠিন বাস্তবতা হলো কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলেও সিস্টেম নিয়ে যারা প্রাত্যহিক কাজ করে থাকেন তাদের যথাযথ মোটিভেশন নেই। এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারি প্রতিষ্ঠানের ভেতর ও বাইরে ভাগযোগের আঁতাত করে ফেলে। এরা প্রতিষ্ঠানের বৃত্তের বাইরেও রাজনৈতিক ব্লেসিং প্রাপ্ত হয়ে থাকে। যার ফলে প্রতিষ্ঠানের ভেতরের সুশীল সেবকরা এদের চাকে ঢিল ছুঁড়তে সাহস করে না। ফলতঃ সিস্টেম থাকলেও প্রাক-সিস্টেমের বাড়তি অস্তিত্ব থাকায় সরকার প্রবর্তিত সিস্টেম আশানুরূপ কাজ করছে না। জনগণ প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছে না। এ জন্য তাদের মাঝেও সরকারি দপ্তর সমূহের বিষয়ে তীব্র নেগেটিভ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে। এ থেকে যথাশীঘ্র সম্ভব বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ আর শক্তিশালী হতে পারবে না। জনগণের আস্থাও অর্জন করতে পারবে না। অথচ সাম্প্রতিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ডিজিটালাইজেশন ও অনলাইন সেবার বিকল্প কিছু হতে পারে না। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক এটাই জনগণের প্রাত্যহিক নিবেদন।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

আনোয়ার হাকিম মুক্তমত সিস্টেম