Saturday 01 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সম্ভাবনার বিশালতা, সংকটের চাপ — চামড়া শিল্প কোন পথে?

মাসুদ রানা
৩ আগস্ট ২০২৫ ১৫:৪৩

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির পাশাপাশি শিল্পখাতের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে চামড়া শিল্প একটি প্রাচীন এবং সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিবেচিত হয়ে আসছে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমল থেকেই ঢাকাসহ কয়েকটি অঞ্চলে চামড়ার ব্যবসা গড়ে উঠেছিল। সময়ের পরিবর্তনে এ খাতটি শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও জায়গা করে নিতে পেরেছে। বিশ্বের অন্যতম চামড়া রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে বাংলাদেশ।

তবে, এই খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে—এই শিল্পের প্রকৃত অবস্থা কী, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো কী, এবং কীভাবে ভবিষ্যতে এগুলো অতিক্রম করে একটি টেকসই ও উন্নত শিল্পব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৯০ লাখ থেকে ১ কোটি গবাদি পশু কোরবানির সময় জবাই করা হয়। এ বছর কুরবানি হয়েছে ৯১ লাখের বেশি। গত বছর এই সংখ্যাটি ছিলো ১ কোটি ৪ লাখ। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ২০১৯ সালে কুরবানি হয়েছিলো সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পশু-১ কোটি ৬ লাখেরও বেশি। আর ২০২১ সালে সর্বনিম্ন ৯০ লাখ পশু কুরবানি হয়েছিলো। এই বিপুল পরিমাণ কুরবানি বিশাল পরিমাণ কাঁচা চামড়ার উৎস।

এই চামড়াগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হয় ফিনিশড লেদার, যেটি দিয়ে তৈরি হয় জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, গ্লাভসসহ নানা রকম পণ্য। এর ফলে তৈরি পোশাক খাতের পর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

এই খাতের সঙ্গে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। ঢাকার হেমায়েতপুরে গড়ে ওঠা চামড়া শিল্পনগরী এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শতাধিক ছোট-বড় ট্যানারি কারখানা, ওয়ার্কশপ ও কুটির শিল্প—সব মিলে এই খাতটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চামড়া পণ্যের প্রধান আমদানিকারক দেশ। সাশ্রয়ী শ্রমশক্তি, স্বল্প উৎপাদন খরচ এবং কাঁচামালের সহজলভ্যতা আমাদেরকে একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে পারত, যদি সঠিক নীতিমালা, অবকাঠামো এবং পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকত।

বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও দেশীয় চামড়াশিল্পের বিকাশ না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দেশের চামড়াশিল্পের কমপ্লায়েন্স (দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) অর্জন করতে না পারা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) এক গবেষণা অনুসারে, এ জন্য যেসব কারণ দায়ী, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) সক্ষমতার অভাব, কমপ্লায়েন্স সম্পর্কে ট্যানারিমালিকদের যথাযথ ধারণা না থাকা, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও ট্যানারির অভ্যন্তরীণ পরিবেশের মান উন্নত না হওয়া। এসব কারণে চামড়াশিল্পের মানসনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) থেকে স্বীকৃতি পাচ্ছে না সাভারে অবস্থিত ট্যানারিগুলো। ফলে দেশে প্রক্রিয়াজাত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রপ্তানি করতে হচ্ছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চামড়া খাতের ১ হাজার ২০৬টি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। এই সনদ পাওয়া বেশি কোম্পানি রয়েছে ইতালিতে ২৫৪টি, ভারতে ২৫১টি এবং চীনে ২০৬টি সনদ পাওয়া কারখানা আছে। অপরদিকে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সনদ পাওয়া কারখানা রয়েছে মাত্র ৭টি।

চামড়া শিল্পকে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর করা হয় মূলত পরিবেশ দূষণ রোধে। কিন্তু এই চামড়া শিল্প নগরীর পরিবেশ দূষণের কারণে এগোতে পারছে না পুরো দেশের চামড়া শিল্প। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাভারের হেমায়েতপুরের ২০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত চামড়া শিল্প নগরী বাস্তবায়নে ইতিমধ্যে ২০ বছর পার করেছে সরকার। চামড়া শিল্প নগরীতে জমি বরাদ্দ পেয়েছিল ১৫৪টি ট্যানারি। তার মধ্যে উৎপাদনে আছে ১৪২টি কারখানা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারটি পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি। এত বছরেও কঠিন বর্জ্য ফেলার ডাম্পিং ইয়ার্ডের কাজ শুরু হয়নি। ফলে বুড়িগঙ্গা নদীর পর ধলেশ্বরী নদী দূষণের শিকার হচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি এবং আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া না থাকায় আমাদের রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

প্রতিবছর কোরবানির সময় কাঁচা চামড়ার সঠিক মূল্য নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা দেখা যায়। প্রতি বছরের মতো এবারও কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। ঢাকায় সর্বনিম্ন কাঁচা চামড়ার দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আর ঢাকার বাইরে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ১৫০ টাকা। এ ছাড়া খাসির চামড়ার ক্রয়মূল্য প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম ২০ থেকে ২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কোথাও সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া বিক্রি করতে পারেনি। গ্রামাঞ্চলে কুরবানির ড় গরুর চামড়া ৫০০ টাকাতেও বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। অন্যদিকে ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ১০-২০ টাকা। আবার ন্যায্য মূল্যে চামড়া বিক্রি করতে ব্যর্থ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অনেক সময় চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেন বা নষ্ট করে দেন। এতে একদিকে কৃষকের ক্ষতি হয়, অন্যদিকে শিল্প খাতের কাঁচামাল সংকট দেখা দেয়।

এর পাশাপাশি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং প্রশিক্ষিত জনশক্তির অভাবে বাংলাদেশ এখনও চামড়া প্রক্রিয়াকরণে অনেকটাই পশ্চাদপদ। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন অপরিহার্য।

অনেক উদ্যোক্তা প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন অথবা জটিল শর্তের কারণে ঋণ গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা না পেলে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয় না, পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোও টিকে থাকতে পারে না।

যেসব দেশ পরিবেশবান্ধব এবং সামাজিকভাবে টেকসই উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেয়, তারা বাংলাদেশ থেকে চামড়া আমদানিতে অনাগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে। ফলে রপ্তানির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে এবং আমাদের আন্তর্জাতিক সুনাম হুমকির মুখে পড়ছে।

চামড়া শিল্পের সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান—সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত করতে সাভার চামড়া শিল্পনগরীর সিইটিপি দ্রুত কার্যকর করতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশি কারিগরি সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। কাঁচা চামড়ার সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে ঈদের মৌসুমে সরকারি মনিটরিং টিম নিয়োগ করা উচিত। ট্যানারি মালিকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণপ্রদান এবং শিল্পে নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে ভর্তুকি বা প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। চামড়া খাতে প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের জন্য টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দক্ষ কর্মশক্তি গড়ে তোলা ছাড়া এই শিল্পের টেকসই ভবিষ্যৎ সম্ভব নয়। ‘Made in Bangladesh’ ব্র্যান্ড হিসেবে চামড়া পণ্যকে আন্তর্জাতিকভাবে ব্র্যান্ডিং করা উচিত, বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব ও নৈতিক উৎপাদনের দৃষ্টিকোণ থেকে।

চামড়া শিল্প শুধু একটি অর্থনৈতিক খাত নয়; এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, দক্ষতা ও সম্ভাবনার প্রতীক। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং আগামী দিনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও শক্তিশালীভাবে উপস্থাপন করতে হলে প্রয়োজন সাহসী সিদ্ধান্ত, নীতিনির্ধারকদের আন্তরিকতা, এবং সময়োপযোগী বিনিয়োগ। টেকসই উৎপাদন, পরিবেশ সচেতনতা এবং দক্ষ জনশক্তির সমন্বয় ঘটাতে পারলে চামড়া শিল্প বাংলাদেশের ‘পরবর্তী পোশাক শিল্প’ হয়ে উঠতে পারে—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি