Monday 22 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন

আজহার মাহমুদ
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:৫৫

বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বলা যায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা উৎসবের মতো করে হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের ভোটের অধিকার ফিরে পেয়েছে। ডাকসু ৫ বছর পর হলেও জাকসুতে ৩৩ বছর পর ভোট দিতে পেরেছে ছাত্র-ছাত্রীরা। সেইসাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ধাপে ধাপে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে বুঝতে হলে দুটি ক্ষেত্র বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়—ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং জাতীয় নির্বাচন। এই দুটি নির্বাচন আপাতদৃষ্টিতে আলাদা হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। একদিকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন তরুণ প্রজন্মকে গণতান্ত্রিক অনুশীলনের সুযোগ দেয়, অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিফলন ঘটায়। ফলে বলা যায়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন ভবিষ্যতের জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির একটি ক্ষুদ্র আয়না, আর জাতীয় নির্বাচন হলো সেই নেতৃত্বের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র সমাজ সবসময় ছিল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ভাষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—সবকিছুতেই ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার পরও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই থেকে শুরু করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতি সবসময় জাতীয় রাজনীতির অনিবার্য অংশ হয়ে থেকেছে। এ কারণে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে শুধু ক্যাম্পাসের নেতৃত্ব নির্বাচন নয়, বরং ভবিষ্যৎ জাতীয় রাজনীতির পূর্বাভাস হিসেবেও দেখা হয়।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রকৃতি ভিন্ন হলেও এর প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এই নির্বাচন শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তোলে, তাদের মধ্যে নেতৃত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা শেখায়। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে নেতৃত্ব তৈরির ক্ষুদ্র এক ল্যাবরেটরি। প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে প্রচারণা, ভোট গ্রহণ, ফলাফল মেনে নেওয়া—সবকিছুই তরুণদের রাজনীতির বাস্তব পাঠ দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে যারা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী নেতা উঠে এসেছেন, তাদের অনেকে এই ছাত্র সংসদের মাঠ থেকেই রাজনীতির হাতেখড়ি নিয়েছিলেন।

কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিতভাবে হয়নি। বিশেষ করে নব্বই দশকের পর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে নতুন প্রজন্ম গণতান্ত্রিক অনুশীলনের সুযোগ হারায় এবং ছাত্র রাজনীতি ক্রমশ সন্ত্রাস, দখল ও সহিংসতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যখন নেতৃত্ব গঠনের জায়গায় সহিংসতা দখল নেয়, তখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন তার প্রকৃত লক্ষ্য পূরণ করতে পারে না। এর প্রভাব সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতেও পড়ে। কারণ, জাতীয় রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয় না, পুরনো নেতৃত্ব দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থেকে যায়, আর তরুণদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহ বাড়ে।

শুধু তা-ই নয়, এটি সরাসরি জাতীয় নির্বচনেও প্রভাব ফেলে। জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা নির্ধারিত হয়, আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন সীমিত হলেও নেতৃত্বের অনুশীলনের জায়গা তৈরি করে। সেইসাথে আরও বলা যায়, একটি শক্তিশালী ছাত্র সংসদ নির্বাচন ভবিষ্যতে একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের জন্য মঞ্চ তৈরি করে। কারণ, যারা ছাত্র সংসদের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা করে বড় হয়, তারাই জাতীয় পর্যায়ে এসে বিরোধী মতকে সহ্য করা, ভোটের ফলাফল মেনে নেওয়া এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলে।

দীর্ঘ বিরতির পর যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে, তখনও সেখানে নানান অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। জাকসু নির্বাচনে ভোট বর্জনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। মেনে না নেওয়ার সংস্কৃতি ডাকসু নির্বাচনের অনেক প্রার্থীর মন্তব্য দেখেও স্পষ্ট হই আমরা। সেইসাথে প্রভাবশালী দলগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করার মানসিকতা এখনও পরিপূর্ণভাবে পরিবর্তন হয়নি। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে রাজনীতির প্রতি বিমুখ হয়ে যায়, যা ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহে রূপ নেয়।

একইসাথে এটি জাতীয় নির্বাচনে বড় সংকট হয়ে দাঁড়াবে। যাকে আমরা আস্থার সংকট হিসেবে মনে করতেই পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব নির্বচন সারাদেশের মানুষ নজরে রাখছে। এখানে যদি অনিয়ম, অসঙ্গতি প্রকাশ পায় সেটি জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলবে। ভোটাররা বিশ্বাস হারাবে। ভোট দেওয়া থেকে অনেকেই তখন বিরত থাকবে। সেইসাথে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েও তখন প্রশ্ন উঠবে।

তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে হবে স্বচ্ছ ও সুন্দর ভাবে। সেইসাথে প্রতিটি প্রার্থীর সাথে সৌহাদ্য এবং গঠনমূলক আলোচনা-সমালোচনা থাকবে। এই বাংলাদেশে কোনো ধরনের সহিংসতার রাজনীতি আর কেউ প্রত্যাশা করে না। এখানে সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির রাজনীতি সকলেই পছন্দ করে। সেটা ডাকসু নির্বচনের মাধ্যমেই সকলে প্রমাণ পেয়েছে। যারা ফলাফল মেনে নিয়েছে তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা যেমন ছিলো, যারা প্রত্যাখ্যান করেছেন তাদের প্রতিও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিলো সেটা সকলেই দেখেছে। একইসাথে বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক সেটাই প্রত্যাশা রাখি।

কারণ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীরা যদি বিতর্ক, যুক্তি ও ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত হয়, তবে তারা জাতীয় পর্যায়েও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করবে। কিন্তু যখন ক্যাম্পাসে বিরোধী মত দমন করা হয়, ফলাফল মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি থাকে না, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে রাজনীতি পরিচালিত হয়, তখন সেই ধারা জাতীয় রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হয়। তাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে দাঁড় করাতে হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত রাখা অপরিহার্য। এজন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার ক্ষমতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা। ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় আধিপত্য থেকে মুক্ত করতে হবে, শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে।

পরিশেষে বলা যায়, ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেবল ক্যাম্পাস রাজনীতির বিষয় নয়, বরং এটি জাতীয় গণতন্ত্রের প্রস্তুতিমঞ্চ। আর জাতীয় নির্বাচন হলো সেই গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন। একটি দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্ভর করে তার তরুণ প্রজন্মের হাতে, আর তরুণদের রাজনৈতিক অনুশীলন নির্ভর করে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ওপর। সুতরাং ছাত্র সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও নিয়মিত করা ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা সম্ভব নয়।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

আজহার মাহমুদ ছাত্র সংসদ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

রাকসু নির্বাচন পিছিয়ে ১৬ অক্টোবর
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৯:৫৩

আরো

সম্পর্কিত খবর