সম্প্রীতির মূল ভিত্তি হলো ভালোবাসা ও সহমর্মিতা। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই সত্যকে আমরা যুগ যুগ ধরে ধারণ করে আসছি। এখানে বহু ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মিলেমিশে বসবাস করেছে। মুক্তিযুদ্ধেও আমাদের শক্তির মূল ছিল এই অসাম্প্রদায়িক চেতনা। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বারবার দেখা গেছে—রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, হঠাৎ সহিংসতা কিংবা নির্বাচনী উত্তাপের সময় সংখ্যালঘুরা বিশেষভাবে আক্রান্ত হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আবারও আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, কীভাবে অসাম্প্রদায়িকতার শেকড়কে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে।
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে শুরু হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এ উৎসবকে ঘিরে আনন্দ-উৎসবের পাশাপাশি শঙ্কার ছায়াও দেখা দেয়, কারণ অতীতে বহুবার প্রতিমা ভাঙচুর, মন্দিরে হামলা বা সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা ঘটেছে। যার সর্বশেষ ঘটনা ঘটেছে গতবছর ৫ আগস্ট— আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দু, খ্রিষ্টান, আহমদিয়া, সাঁওতালসহ একাধিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ হয়। বাড়িঘর ভাঙচুর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া, উপাসনালয়ে হামলা—সবই ঘটে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে। একটি জাতীয় দৈনিকের অনুসন্ধান মতে, গতবছরের ৫ থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে অন্তত ১,০৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হামলা হয়েছে ২২টি উপাসনালয়ে। এই পরিসংখ্যান শুধু ভুক্তভোগীর ক্ষতি নয়, বরং রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ওপর সরাসরি আঘাত। যেটা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য একটি কলঙ্ক। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই নয়, বরং গোটা জাতিকে কলঙ্কিত করে। তাই প্রশ্ন জাগে—কীভাবে আমরা একসঙ্গে থেকে এই উৎসবকে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ করতে পারি?
প্রথমত, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংবিধান স্পষ্ট ভাষায় বলছে—ধর্ম, গোষ্ঠী, নারী–পুরুষ বা জন্মস্থানভেদে কোনো বৈষম্য চলবে না। সংবিধান নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ দুর্গাপূজার নিরাপত্তা দেওয়া কেবল নৈতিক নয়, এটি সাংবিধানিক দায়িত্বও বটে। তাই সরকারের দায়িত্ব হলো প্রতিটি পূজামণ্ডপে যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া। কেবল আনুষ্ঠানিক নির্দেশনায় থেমে গেলে হবে না, বাস্তবে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক, সক্রিয় ও জনবান্ধব হতে হবে। তাদের মনোবল যেন কোনোভাবেই ভেঙে না পড়ে, সেটিও নিশ্চিত করা জরুরি। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নারী পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবীদের অন্তর্ভুক্তি এই আয়োজনে সবার অংশগ্রহণ ও আস্থা আরও বাড়াবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও বলেছে, নাগরিক যদি নিজের দেশে অসহায় বোধ করেন, তাহলে মানবাধিকারের সুরক্ষা সম্ভব নয়। কাজেই পূজা উপলক্ষে ৩৩ হাজারেরও বেশি মণ্ডপে নিরাপত্তা দেওয়া কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি সরাসরি মানবাধিকার রক্ষার অংশ। এজন্য বিট পুলিশিং, সিসিটিভি, কন্ট্রোল রুম, নারী পুলিশ নিয়োগ, স্বেচ্ছাসেবক তালিকা—সবগুলো বিষয় সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রশাসনিক শৈথিল্য এখানে কোনোভাবেই কাম্য নয়।
দ্বিতীয়ত, স্থানীয় পর্যায়ের সামাজিক শক্তিকেও কাজে লাগাতে হবে। মন্দির বা মণ্ডপ শুধু কোনো একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানস্থল নয়, ব পুরো এলাকার উৎসবের কেন্দ্র। তাই স্থানীয়ভাবে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ—সব ধর্মের তরুণ-যুবকদের সম্পৃক্ত করা গেলে তা হবে সম্প্রীতির সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা। যখন এলাকার মুসলমান যুবকরা হিন্দু প্রতিবেশীর পূজামণ্ডপ পাহারা দেয়, কিংবা একসঙ্গে প্রতিমা বিসর্জনে শৃঙ্খলা রক্ষায় এগিয়ে আসে, তখনই প্রকৃত অর্থে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ছবি ফুটে ওঠে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, স্থানীয় উদ্যোগে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা অনেক সময় প্রশাসনিক তৎপরতার চেয়েও কার্যকর হয়েছে।
তৃতীয়ত, আজকের ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ধর্মীয় উসকানি ও গুজব সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায় এখান থেকেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উস্কানি ও গুজবের কারণে অনেক সংঘর্ষের সৃষ্টি করেছে। কাজেই ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে নজরদারি জোরদার করতে হবে। তবে কেবল আইন দিয়ে দমন নয়, জনসচেতনতা তৈরি করাও সমান জরুরি। মানুষকে বোঝাতে হবে—ধর্ম নিয়ে গুজব বা ঘৃণাচর্চা কেবল সংখ্যালঘুর ক্ষতি করে না, বরং পুরো সমাজের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে।
চতুর্থত, পূজামণ্ডপে ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ে। তাই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, বিদ্যুতের নিরাপদ সংযোগ এবং বিকল্প আলোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একইভাবে প্রতিমা বিসর্জনের সময় নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এতে মানুষ ভয়ের বদলে উৎসবমুখর পরিবেশ উপভোগ করতে পারবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের নয়, বরং সব নাগরিকের দেশ। যদি এই মাটিতে কেউ নিজেকে সংখ্যালঘু বা অসহায় ভাবে, তবে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। দুর্গাপূজা সামনে রেখে আমাদের প্রত্যেকেরই অঙ্গীকার হওয়া উচিত—ভিন্ন ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কেবল সহনাগরিকই নয়, তারা আমাদের আত্মীয়, প্রতিবেশী, সহকর্মী। তাদের নিরাপত্তা মানে আমাদেরই নিরাপত্তা।
আমরা চাই, এ বছরের দুর্গাপূজা হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ। পুলিশ, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন—সবাই আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে এবং সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ থাকলে বাংলাদেশ প্রমাণ করতে পারবে, বৈচিত্র্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে প্রকৃত শক্তি। বিভেদ নয়, একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই আমাদের মুক্তির পথ। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, কোনো নাগরিক যেন কেবল তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ভীত না হয়। বরং মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবাই একসাথে এগিয়ে আসুক, যেন বাংলাদেশ বিশ্বকে দেখাতে পারে—ভালোবাসা, সহমর্মিতা আর ঐক্যের শক্তিই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী