Sunday 05 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শান্তিচুক্তির ২৭ বছর পরও অশান্ত পাহাড়: সমাধান কোথায়?

মাসুদ রানা
৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:১৭

সাম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়ির পাহাড়ে যে গভীর অস্থিরতা ও সহিংসতার কালো ছায়া নেমে এসেছে, তা শুধু স্থানীয় বাসিন্দাদেরই নয়, গোটা জাতিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত সবুজ এই জনপদ আজ পরিণত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে। সশস্ত্র সংঘাত, পাল্টাপাল্টি হামলা এবং চাঁদাবাজির মতো ঘটনাগুলো নিত্যদিনের খবরে পরিণত হয়েছে, যা স্পষ্টতই ইঙ্গিত দেয় যে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি গুরুতর সংকটের মুখে। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে প্রতিটি বিবেকবান মানুষের হৃদয় থেকে একটিই আওয়াজ ওঠে— অস্ত্রের ঝনঝনানি থামুক, আমরা শান্তি চাই।

পাহাড়ের এই অস্থিরতার সবচেয়ে বড় শিকার সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়ত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় ঘরছাড়া হচ্ছেন নিরীহ মানুষ, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্কুল, কলেজ, হাট-বাজার—সবখানেই বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক। কৃষি ও পর্যটন, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতির মূল ভিত্তি, তা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যে খাগড়াছড়ি পর্যটকদের কাছে ছিল এক আকর্ষণীয় গন্তব্য, সেই জনপদ এখন সংঘাতের কারণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রশ্ন, এই রক্তপাত কাদের স্বার্থে? স্থানীয় রাজনৈতিক ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে কেন জিম্মি হবে পাহাড়ের সহজ-সরল মানুষের জীবন? সহিংসতা কখনো কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না, বরং তা শুধু দীর্ঘমেয়াদি বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়।

বিজ্ঞাপন

গুইমারায় সৃষ্ট পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিবৃতি বা উপস্থিতি অনেক সময় স্থানীয়দের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। তবে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা হলো— নিরাপত্তা বাহিনী কেবল তাৎক্ষণিক শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়, বরং পক্ষপাতহীনভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং নিরীহ মানুষের জানমাল রক্ষায় আরও বেশি সংবেদনশীল ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। কোনো পক্ষের উস্কানিতে প্রভাবিত না হয়ে, সকল সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ও সমন্বিত অভিযান চালানো এখন সময়ের দাবি।

আমরা ভুলে যাই না, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছিল এই আশায় যে, দীর্ঘ দুই দশকের সশস্ত্র সংঘাতের অবসান ঘটবে এবং পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরবে। চুক্তিতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, ভূমি কমিশন, শরণার্থী পুনর্বাসন, সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার এবং পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলার মতো প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২৭ বছর পরও সেই প্রতিশ্রুতিগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ভূমি কমিশন আজও কার্যকর হয়নি, শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের পুনর্বাসন প্রশ্নবিদ্ধ, সেনা ক্যাম্প অনেক ক্ষেত্রে এখনো বহাল, আর স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।

ফলশ্রুতিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে আস্থার ঘাটতি ছিল, তা কাটেনি। বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও অনেকে মনে করে, চুক্তি তাদের স্বার্থকে উপেক্ষা করেছে। এই পারস্পরিক অবিশ্বাসকে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কাজে লাগাচ্ছে। নানা অজুহাতে হরতাল, অবরোধ, মিছিল কিংবা অনলাইনে ঘৃণামূলক প্রচারণার মাধ্যমে উত্তেজনা বাড়ানো হচ্ছে। একবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে তা দ্রুতই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার রূপ নেয়— যেমনটি খাগড়াছড়িতে দেখা গেল।

পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির পেছনে অন্যতম কারণ ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়া। শান্তিচুক্তি হওয়ার পর থেকে গত ২৮ বছরে পাহাড়িদের সংগঠনগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে প্রায়শই সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায় এবং তাতে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। চুক্তি হয়েছিল সন্তু লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বা পিসিজেএসএস সংগঠনের। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এই সংগঠন থেকে সিনিয়র কিছু নেতা বের হয়ে গঠন করেন আরো একটি গ্রুপ- পিসিজেএসএস- এম এন লারমা। ১৯৯৭ সালেই চুক্তির বিরোধিতা করে তৈরি হয়েছিল ইউপিডিএফের। পরবর্তীতে সেটাও ভেঙে গঠিত হয়েছে নতুন আরেকটি গ্রুপ- ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। অনেকে মনে করেন, চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার হতাশা থেকে এসব সংগঠন ভেঙে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ এর পেছনে রাজনৈতিক গন্ধও পান।

শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের পরের বছরই গঠিত হয়েছিল আঞ্চলিক পরিষদ এবং বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি- এই তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। কিন্তু তারপর থেকে গত দুই দশকে এসব পরিষদে একবারেরও জন্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। শুরুতে যাদেরকে সেসব পরিষদে বসানো হয়েছিল তারাই এখনও এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এসব পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা স্থানীয় ভোটারদের হাতে। কিন্তু কারা ভোটার হবেন এবং কারা হবেন না- এনিয়েও বিদ্যমান বিরোধে সেই ভোটারদের তালিকাও তৈরি হয়নি। এমনকি স্পষ্ট নয় এসব প্রতিষ্ঠানের কার কি ক্ষমতা। তাদের কাছে ক্ষমতাও পূর্ণ হস্তান্তর হয়নি। সরকার ও এসব প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক ও আস্থার সঙ্কট তৈরি হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটের অন্যতম একটি কারণ ভূমি মালিকানা বিরোধ। ব্রিটিশ আমলের আইনে প্রথাগতভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকেই ভূমির মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও তাদের কাছে মালিকানার দলিলপত্র নেই। পরবর্তীতে বাঙালি পুনর্বাসনের ফলে ভূমি বিরোধ জটিল আকার ধারণ করে। শান্তিচুক্তিতে ভূমি কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও বাঙালি সেটলারদের প্রসঙ্গ উল্লেখ না থাকায় তা কার্যকর সমাধান দিতে পারেনি। ২০০১ সালে কমিশন গঠিত হলেও বিরোধও নিষ্পত্তিতে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। যার ফলে বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকে।

চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে ছয়টি ক্যান্টনমেন্টের বাইরে অবস্থিত অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি বলে অভিযোগ পাহাড়ি জনগোষ্ঠির। তবে বাস্তবতা হলো— ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেয়া হয়েছে ৯৫টি সেনা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন বাহিনীর ২৪১টি ক্যাম্প। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় সেনা ক্যাম্প রয়েছে ১১৩টি। যা দিয়ে শান্তি বজায় রাখতে নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে কাজ করছেন বলে জানান সেনা সদস্যরা। অভিযোগ মিলেছে, নিজেদের চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ ঢাকতে নিরীহ পাহাড়িদের কাছে সেনাবাহিনীকে নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায় সশস্ত্র সংগঠনগুলো।

অস্থিরতার পেছনে আরো একটি কারণ হচ্ছে এই অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান। প্রত্যন্ত, দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকা হওয়ার কারণে নিরাপত্তা বাহিনী খুব দ্রুত ও সহজে সেখানে পৌঁছাতে পারে না। গত কয়েক বছরে ওই এলাকায় অনেক রাস্তাঘাট হয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন সেতুও, বিশেষ করে বান্দরবানে। সাজেকের মতো দুর্গম এলাকাতেও তৈরি হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও এরকম দুর্গম জায়গা রয়ে গেছে যেখানে যেতে হয় পায়ে হেঁটে এবং সেসব জায়গায় পৌঁছাতে দু’তিনদিনও লেগে যেতে পারে। সারা দেশে যেভাবে উন্নয়ন হয়েছে সেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন হয়নি। দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে উন্নয়নের জন্যে সেখানে যে বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা ছিল সেরকমও হয়নি বলেই মনে করে স্থানীয়রা।

এই অস্থিরতা নিরসনে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আমরা চাই, সরকার এবং সকল পক্ষের উচিত হবে আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করা। স্থানীয় সশস্ত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার বিভেদ দূর করতে অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও ফলপ্রসূ সংলাপের আয়োজনের উদ্যোগ নিতে হবে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি দ্রুত, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সঙ্গে পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা হোক, যাতে সশস্ত্র সংঘাতের মূল কারণগুলো দূর হয়। কোনো গোষ্ঠী বা দলের প্রতি নমনীয়তা না দেখিয়ে, সকল প্রকার চাঁদাবাজি ও সহিংসতাকে কঠোর হাতে দমন করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হোক।

খাগড়াছড়ি তার শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতি নিয়ে আবার হাসুক। পাহাড়ের মানুষের মুখে ফিরুক স্বস্তির হাসি। মনে রাখতে হবে, যেকোনো পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন ও নিরাপত্তা সবার আগে। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফেরাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নিরাপত্তা বাহিনীর নিরপেক্ষতা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ— এই তিনের সমন্বয়ই একমাত্র সমাধান। অস্ত্রের শক্তি নয়, সংলাপের আলোয় পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত হোক।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি

অশান্ত পাহাড় খাগড়াছড়ি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী মাসুদ রানা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর