Thursday 16 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রযুক্তি, জলবায়ু ও কৃষি: ঝিনাইদহে টেকসই চাষাবাদের চ্যালেঞ্জ

মো. শাহিন রেজা
১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:২২

দেশের অন্যান্য জেলার মতো ঝিনাইদহের অর্থনীতিও কৃষিনির্ভর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি কাজে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে। সাথে কৃষিতে প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার, সার ডিজেলের দাম বৃদ্ধি, পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা অসংগতি ঝিনাইদহের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক দিয়ে জেলাটি বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। এখানে বৃষ্টিপাতের অস্বাভাবিকতা ও খরার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ি করা হয়। এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের স্বল্পতা ও সঠিক পরিকল্পনা কৃষিতে চ্যালেঞ্জের অন্যতম কারণ। এবং মূল সমস্যা হিসেবে এগুলোর সমাধান না করা গেলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে।

বিজ্ঞাপন

ঝিনাইদহে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব:

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন সব থেকে আলোচিত বিষয়। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহ জেলাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে ঝিনাইদহে গত এক দশকে খরার প্রকোপ ২৩% বেড়েছে (BARC)। ২০১২-২০২২ সালে ঝিনাইদহে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৮.৫% হ্রাস পেয়েছে (আবহাওয়া অধিদপ্তর)। অন্যদিকে, গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে বলা যায়, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন হয়েছে। এতে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দিচ্ছে। ঝিনাইদহের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলাতে প্রতি বছর গড়ে ৪-৫ বার কালবৈশাখী ঝড় হয়। এতে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। কৃষকেরা আর্থিক ভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কারণ পণ্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও ন্যায্য মূল্য না পাওয়াতে এই প্রভাব প্রকট রূপ নিচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে নানা পোকামাকড়ের বিস্তার ঘটেছে। এতে কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহার বাড়ছে যা পরিবেশের ক্ষতির কারণ।

প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও সীমিত ব্যবহার:

আমাদের দেশের কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে জানাশোনা কম। ফলে কৃষিতে তেমন প্রযুক্তির ছোঁয়া পাইনি। কৃষি শুমারি ২০১৯ অনুযায়ী, ঝিনাইদহের মাত্র ১৮.৩% কৃষক আধুনিক কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করেন (BBS)। এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকার মাধ্যম কৃষি কাজ হলেও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও ব্যবহারে পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করে। কারণ বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন এবং মোবাইল ব্যবহার করে আবহাওয়া ও ঝড়ের পূর্বাভাস সম্পর্কে জানা যায়। আবার, ই-কমার্স পণ্যের ন্যায্য মূল্য পেতে সহায়তা করে। কিন্তু জনবল সংকট, কৃষি বিষয়ক জ্ঞান/শিক্ষা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের অভাব কৃষকদের প্রযুক্তি ব্যবহার শেখার প্রধান অন্তরায়।

বাজার ব্যবস্থার অসংগতি ও কৃষকদের ঠকানোর মনোভাব:

ত্রুটিপূর্ণ কৃষি বিপণন ব্যবস্থা কৃষকদের সঠিক দাম থেকে বঞ্চিত করছে। ঝিনাইদহ কৃষি বিপণন অফিসের মতে, পেঁয়াজ, রসুন, কলা ও শাকসবজি বিপণনে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার হার প্রায় ৩০%। অসাধু ব্যবসায়িদের কারণে কৃষকরা সঠিক দাম পাচ্ছেন না। যারা রোদ বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন তাদের ঠকাতে সব ধরনের আয়োজন করেন অসাধু ব্যবসায়িরা। অন্যদিকে, সংরক্ষণ কেন্দ্র না থাকাতে পণ্য সংরক্ষণ করা যায় না। ফলে কৃষকরা অনেক সময় ন্যায্য দাম না পেলেও পণ্য বিক্রি করে দেন। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাজারের দূরত্ব ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ কৃষি পণ্য বিক্রয়ের পথে বাঁধা সৃষ্টি করে।

আছে কিছু সম্ভাবনার কথা:

কৃষি পণ্য উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় নানা ধরনের সমস্যা থাকলেও কিছু সম্ভাবনার কথা বলা যাবে। যেমন দেশের অন্যতম বড় ড্রাগন ফলের বাজার মহেশপুরে। এখানে কয়েক হাজার মানুষ কাজ করছেন। পাশ্ববর্তী এলাকায় ড্রাগনের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়াতে এই বাজার ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়ে। ২০২১ সালে যৌথভাবে BRRI ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু ও কালীগঞ্জ উপজেলায় ‘জলবায়ু সহনশীল ধানের জাত (BRRI dhan75, 89)’ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। গবেষণার দেখা যায় এই জাতগুলো খরায় ২০-২৫% বেশি ফলন দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জলবায়ু সহনশীল বিভিন্ন পণ্যের বীজ রোপণ করে সফলতা পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় ও খরা প্রবণ এলাকায় এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও তরুণরা কৃষি উদ্যোক্তা হচ্ছেন যা কৃষি বিস্তার ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। জাতীয় পরিসংখ্যান ও স্থানীয় সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ধান ছাড়াও পান, গম, আখ, পাট, শাকসবজি, ডাল ঝিনাইদহ জেলার প্রধান কৃষিজ ফসল। তবে এখানে বেশি ধান উৎপাদন হয়। এবং জেলার মহেশপুর উপজেলাকে বলা হয় খুলনা বিভাগের শস্য ভান্ডার। বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে ড্রাগন, মাল্টা, পেয়ালা সহ নানা ধরনের ফল চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা রিপোর্ট অনুযায়ী, ঝিনাইদহে বর্তমানে প্রায় ৪,০০০ হেক্টর জমিতে ফলের চাষ হচ্ছে। ফলে বলা যায় ফলের একটি বড় যোগানদাতা হচ্ছে ঝিনাইদহ জেলা।

কৃষিতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু প্রস্তাবনা:

১. জলবায়ুর সাথে খাপ খাওয়াতে গবেষণা বৃদ্ধি করতে হবে যার মাধ্যমে নতুন জাতের বীজ উদ্ভাবন করে পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা যাবে। ভূগর্ভস্থ পানির উপর চাপ কমাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। জেলার মধ্যে প্রবাহিত নদ/নদী খনন করে কৃষি সেচের কাছে এই পানি ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও কৃষি পরিবেশ উন্নয়নে গবেষণালব্ধ জ্ঞান কাজে লাগানো গেলে সব ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করা অনেকটা সম্ভব।

২. কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ ও বিনা সুদে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা হাতে নেওয়া যায়। সার, ডিজেল ও বিদ্যুৎ এ সরকারি ভর্তুকির পুনর্বিন্যাস করলে কৃষকরা লাভবান হবেন। মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে কেন্দ্রীয় ভাবে আবহাওয়ার খবর প্রচার করতে হবে। দৈনন্দিন পণ্যের বাজার সম্পর্কে খবরাখবর জানানোর ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। বাজার মনিটরিং জোরদারের মাধ্যমে পন্যের দাম ও মান নিশ্চিত করার কাজ করতে পারলে ভোক্তাদের মাঝে মানসম্মত পণ্য সরবরাহ করা যাবে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের পূর্বে ও পরে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে হবে।

৩. কৃষকেরা যাতে নির্ধারিত দামে পণ্য বেচা-কেনা করতে পারে সেই উদ্যোগ নিয়ে বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে। কৃষি বিপণন প্ল্যাটফর্ম আধুনিক ভাবে তৈরি করতে এবং প্রান্তিক কৃষকদের সংগঠিতকরণ, মতামতে গুরুত্ব ও সচেতনতা তৈরি করে দেওয়া গেলে কৃষকদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং নিজেরা পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করতে নিজেদের চিন্তা শক্তি কাজে লাগাতে পারবেন।

৪. কৃষি সম্পর্কিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। মহেশপুর উপজেলাতে এশিয়ার বৃহত্তর কৃষি খামার অবস্থিত। এখানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইপিজেড তৈরি করে কৃষি উন্নয়নে সহায়তা করা যায়। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঝিনাইদহের উৎপাদিত পণ্য, দাম ও মান প্রচার করতে হবে। এতে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করা যাবে। বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি ও ন্যায্য মূল্য পেলে কৃষকরা পণ্য উৎপাদনে উৎসাহী হবেন।

৫. নতুন কৃষি উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়। যেমন প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান ও তাদের পণ্য বাজারজাত করণের ব্যবস্থা করে দেওয়া। শিক্ষিত তরুণদের কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে সম্পৃক্ত করা গেলে বেকারত্ব দূর করা যাবে এবং কৃষিতে সাফল্য অর্জন সম্ভব।

৬. যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন করে সারাদেশে পণ্য বিপণনের সঠিক পরিকল্পনা তৈরি করে দিতে হবে। হিমাগমের সংখ্যা বৃদ্ধি করে কৃষকদের পণ্য সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা যায়।

৭. অর্গানিক চাষাবাদ ও আধুনিকতার ছোঁয়া কৃষিতে দিতে নিয়মিত কৃষকদের মধ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিতরণ, বীজ ও সারের পরিমিত ব্যবহার, প্রাকৃতিক দূর্যোগ, বাজারে পণ্যের চাহিদা, দাম ও মান নিশ্চিতে ট্রেনিং করাতে হবে।

ঝিনাইদহের ভৌগোলিক অবস্থান, মাটি ও সমতল ভূমিরূপ কৃষি কাজের জন্য অনুকূল। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিকে মোকাবিলা করে প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিস্তার ও সুষ্ঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন সম্ভব। যা বেকারত্ব হ্রাস করে এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখবে।

লেখক: কর্মকর্তা, ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ, নারায়নগঞ্জ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর