Thursday 16 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা; সংকট ও চ্যালেঞ্জ

অলোক আচার্য
১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:৪২ | আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:৪৪

একটি টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো দেশের জন্যই প্রধান চ্যালেঞ্জিং বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশগুলো সমণ্বিতভাবে এ সমস্যা মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে কারণ পৃথিবীতে বহু নারী-পুরুষ ও শিশু অভুক্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাচ্ছে। এই সমস্যা আমাদের আগেও ছিল কিন্তু সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে করোনা মহামারী শেষে যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় এবং এরপর থেকেই আরও কয়েকটি যুদ্ধ এবং যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়। এর সাথে যোগ হয়েছে বাণিজ্য যুদ্ধ। সব মিলিয়ে বিশ্ব এক কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। এই অস্থির পরিস্থিতি তৈরির জন্য মানুষই দায়ী। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো যে মানুষগুলো এই সমস্যার তৈরি করেছে তারা কিন্তু খাদ্যের অভাবে কষ্ট পাচ্ছে না। খাদ্যে যে মূল্যস্ফীতি ঘটছে তার জন্য স্বল্প,মধ্য ও ধনী দেশসহ সকলেই ঝুঁকিতে রয়েছে। গত কয়েক বছরে সব জিনিসপত্রের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে কৃষি উপকরণের দাম। বেড়েছে সার ও কীটনাশকের দাম। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে বৃদ্ধি পেয়েছে সরবরাহ খরচ। সবদিক থেকে ফসল উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশেই বেড়েছে খাদ্য পন্যের দাম। ২০২৪ সালে তিন ধাপ নেমেছে বাংলাদেশের ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতার অবস্থান। ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় ১২৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৮৪তম। বৈশ্বিক এ সূচকে মোট ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৯ দশমিক ৪। সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারত (১০৫) ও পাকিস্তানের (১০৯) চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে শ্রীলঙ্কা (৫৬), নেপাল (৬৮) ও মিয়ানমার (৭৪) বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। সাম্প্রতিক সূচকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের পর ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করা কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৪ দশমিক ৭। গতবছর সেটি কমে ১৯ এ নেমে আসে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক প্রবণতার বিপরীতে এসে বাংলাদেশ, মোজাম্বিক, নেপাল, সোমালিয়া ও টোগো তাদের স্কোর ২০১৬ সালের তুলনায় ৫ পয়েন্টেরও বেশি কমাতে সক্ষম হয়েছে। এরপরও বাংলাদেশে যে পরিমাণ ক্ষুধার্ত মানুষ আছে, তা গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। সূচকে বর্তমানে বাংলাদেশ ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধায় আক্রান্ত দেশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি দেশে অপুষ্টির মাত্রা, শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসেব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এই চারটি সূচকের মান এক করে ১০০ পয়েন্টের একটি স্কোর পদ্ধতি সাজায় বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক। সূচক অনুসারে ছয়টি দেশে উদ্বেগজনক পরিমাণে ক্ষুধা বিরাজ করছে। সূচকের সবচেয়ে নিচে থাকা ছয়টি দেশ হচ্ছে- বুরুন্ডি, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, ইয়েমেন, চাদ ও মাদাগাস্কার। সূচকে শীর্ষ পাঁচ দেশ হচ্ছে- বেলারুশ, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, চিলি, চীন এবং কোস্টারিকা।

আর চলতি বছর গত আগষ্ট মাসে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট নিয়ে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ এ বলা হয়েছে, তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকা বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে চতুর্থ স্থানে আছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের পাঁচটি সংস্থা মিলে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থাগুলো হলো এফএও, ইফাদ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও ও ইউনিসেফ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দেওয়া ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস’ শীর্ষক পৃথক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে তীব্র খাদ্যসংকটে থাকা ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। দুই প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু খাদ্যনিরাপত্তার সংকটেই নয়, স্বাস্থ্যকর বা সুষম খাদ্য গ্রহণের দিক থেকেও বাংলাদেশ পিছিয়ে। এ বিষয়ে গত সাত বছরে অনেকটা উন্নতি হলেও এখনো দেশের ৭ কোটি ৭১ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না। দেশের ১০ শতাংশের বেশি মানুষ অপুষ্টির শিকার। জাতিসংঘের পাঁচ সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৫৩টি খাদ্যসংকটপীড়িত দেশ ও অঞ্চলের প্রায় ২৯ কোটি ৫০ লাখ মানুষ চরম খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি।

এর মধ্যে তীব্র খাদ্য অনিরাপত্তার শিকার মানুষের সংখ্যা অনুযায়ী শীর্ষ পাঁচটি দেশ হচ্ছে নাইজেরিয়া, সুদান, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, বাংলাদেশ ও ইথিওপিয়া। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যসংকটে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা, দক্ষিণ সুদান, সুদান, ইয়েমেন ও হাইতি। তবে বাংলাদেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুত আছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সরকার বলছে, এই প্রতিবেদনগুলো নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে।

যুদ্ধের সাথে সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বজুড়ে প্রকৃতিও ছেড়ে কথা বলছে না। জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের (ডিডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে জানা যায়, এক কেজি ধান উৎপাদন করতে সামগ্রিকভাবে ৬০ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। অন্য কোনো ফসল কিংবা আমিষ উৎপাদনে এত বেশি পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয় না, যতটা ধান চাষে প্রয়োজন হয়। দিনকে দিন ভারতে মিঠা পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় দেশটিতে ধান চাষ হুমকির মুখে পড়েছে। বর্তমানে ভারতের মিঠা পানির ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় শুধু ধান চাষের জন্য। এফএওর ২০২৩ সালের ষ্টেট অব ফুড ইনসিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট অনুসারে, ২০২২ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ দশমিক ২ শতাংশ বা ৬৯ কোটি ১০ লাখ থেকে ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। কানাডা ও ইউরোপে দাবানল, দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব আফ্রিকায় খরা, চীনে বন্যা ও ক্যালিফোর্নিয়ার শুষ্ক অংশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য সংকট আরো বেড়েছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে খাদ্যসংকট তীব্র হচ্ছে। এছাড়াও মূল্যস্ফীতি বাড়ায় উন্নত দেশগুলোতেও খাদ্যপণ্যের মূল্য রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনে তো মারাত্বক খাদ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ুর সাথে মানবসৃষ্ট পরিবেশ এর জন্য দায়ী। কম বৃষ্টিাতের ফলে নষ্ট হয়েছে সোমালিয়ার হাজার হাজার একর জমির ফসল। পানি ও খাদ্যশূন্য হয়ে মারা গেছে কৃষকদের গবাদিপশু। বিশে^র ৩৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ এখন তীব্র ক্ষুধার্ত। আর ক্ষুধার্ত মানুষের এই সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একুশ শতকে বিশ্বে আর দুর্ভিক্ষ ঘটবে না বলে বিশ্ব নেতারা প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও সোমালিয়ায় আরও একবার দুর্ভিক্ষ আসন্ন। বিশ্বের ৪৫টি দেশের প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ অনাহারের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। বিশ্বের দুই শতাধিক এনজিও’র বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন প্রায় ১৯ হাজার ৭০০ জন মানুষ ক্ষুধায় মারা যাচ্ছেন। উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশ এবং এমনকি উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও এই মন্দার পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। যুদ্ধের কারণে পণ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে। আরও একটি সমস্যা হলো খাদ্যের সুষম বন্টণ। কোথাও খাদ্য বিপুল পরিমাণে নষ্ট হচ্ছে। সেখানে খাওয়ার মানুষ নেই! আবার কোথাও এক মুঠো ভাতের জন্য হাহাকার!

আমাদের হাতে যুদ্ধ বন্ধ করার বিকল্প নেই। অধিকাংশ মানুষের হাতে তা কেনার মতো অর্থও থাকছে না। এটা একটি মানবিক বিপর্যয়। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। যেখানে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর দারিদ্রতা একটি বড় সমস্যা। এই দারিদ্রতার কারণেই মূলত ক্রয়ক্ষমতা কমে এবং মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং প্রতিদিনের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের জীবনমান নিম্নমুখী হচ্ছে। আগামী কয়েকমাসে পৃথিবী একটি বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হওয়ার মতো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর কারণ হলো যুদ্ধ এবং এর সাথে বহুদিন ধরে চলে আসা সমস্যাগুলো যেমন- বিভিন্ন দেশে দ্বন্দ্ব সংঘাত,জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা এবং শরণার্থী সংকট। এখন এসব সমস্যা আরও বেশি তীব্র হওয়ার মুখে। কারণ বিভিন্ন দেশ খাদ্য সংকটের মুখে দাড়িয়ে। এর মধ্যে পৃথিবীজুড়েই তীব্র শরণার্থী সংকট চ্যালেঞ্জের মুখে দাড় করিয়েছে। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা দাড় করা কষ্টসাধ্য। যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈষম্যের কারণে পৃথিবীতে দারিদ্রতা এবং খাদ্য সংকট তীব্র হচ্ছে। ভয়াবহভাবে দারিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসাথে পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। সেটা সামাল দেয়া বিশ্বের জন্য চ্যালেঞ্জের। দারিদ্রতা, ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, রিজার্ভ কমে যাওয়া, খাদ্যপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি, বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতি বিশ্ব অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন ভোগাবে। যদিও এর সাথে প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন খরা, বন্যা ইত্যাদিও কম দায়ী নয়। টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে একটি ঐক্যবদ্ধ পৃথিবী এই সময় অত্যন্ত জরুরি। আর তা সম্ভব না হলে সত্যি সত্যি এই পৃথিবীকে খাদ্য সংকটে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি
বিজ্ঞাপন

বাবা হলেন হাসনাত আবদুল্লাহ
১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর