Thursday 25 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বায়দূষণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু

মোহাম্মদ আবু নোমান
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৪৮

অত্যন্ত আশ্চর্য, অপ্রত্যাশিত, ভয় ও আতঙ্কগ্রস্থ হওয়ার ইনফরমেশন বিশ্বব্যাংকের! যা শুনলে ‘চোখ কপালে ওঠা’র মতো অবস্থা। খবরটি হলো ‘বায়দূষণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু’। শুধু যে মৃত্যু পর্যন্তই শেষ তা নয়; অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে আঞ্চলিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ১০ শতাংশ। গত ১৮ ডিসেম্বরে প্রকাশিত এ ইনফরমেশন খোদ বিশ্বব্যাংকের না হলে বিশ্বাসযোগ্য হতো না। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ প্রতিদিন অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে, যার ফলে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এর উপর আরো বিস্ময়কর খবর হলো, বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবেশ অর্থনীতিবিদ মার্টিন হেগার বলেছেন, ‘এই প্রতিবেদন দেখাচ্ছে যে ‘সমাধান হাতের নাগালেই’ আছে এবং নীতিনির্ধারক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের জন্য সমন্বিত, বাস্তবসম্মত ও প্রমাণভিত্তিক উদ্যোগ বড় পরিসরে বাস্তবায়নের একটি কার্যকর রূপরেখা দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার ও কৃষকদের জন্য পরিষ্কার প্রযুক্তি ও পদ্ধতি গ্রহণে শক্ত আর্থিক ও অর্থনৈতিক যুক্তি রয়েছে, আর সরকারগুলোর উচিত এ ক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করা।’

তাহলে আমরা বুঝলাম ১০০ কোটি মানুষের অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নেয়া, অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ, আর প্রতিবছর ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যুর ‘সমাধান হাতের নাগালেই’। কিন্তু বিষয়টি হলো- এসব দেখারও যেন কেউ নেই! অনুধাবন, বা অনুভাবন করারও যেন কেউ নেই! হায়রে দেশ! হায়রে মানুষ! যে বাতাস না হলে আমাদের জীবনই বাঁচে না, সে বাতাসেই ভয়াবহ বিপদ! আমরা প্রতিনিয়ত বিষ গ্রহণ করছি! খাবারে বিষ, বাতাসে বিষ, পানিতে বিষ, মাছ, ফল, সব্জিতে বিষ, চলাফেরায় ঝুঁকি। এরকম কত কিছুর ঝুঁকি নিয়েই আমরা চলছি! এটি সত্যিই দুঃখজনক। হতাশার যেন শেষ নেই। সব যায়গায় সমস্যা!

বাতাসে মিশ্রিত সালফার, সিসা, দস্তা ইত্যাদি ধাতুকণা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; বিশেষত শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে বছরে যত মানুষের মৃত্যু ঘটে, তার দুই তৃতীয়াংশই বায়ুদূষণের ফলে। বায়ুদূষণের কারণে হৃদ্রোগ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও ক্যান্সার হয়। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব প্রকট হয়ে থাকে। পৃথিবীর যেসব শহর বায়ুদূষণে ধুঁকছে, বরাবরই সেগুলোর তালিকায় কখনো বাংলাদেশ শীর্ষে, কখনো শীর্ষের কাছাকাছি জায়গা হয় ঢাকা ও তার আশপাশের শহরগুলোর। এছাড়া বহুবার বায়ুদূষণে প্রথম স্থান (চ্যাম্পিয়ন) হওয়ার অর্জনতো আমাদের আছেই।

দেশে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় রয়েছে, আছে সড়ক পরিবহন সংস্থা, রয়েছে সিটি কর্পোরেশন। তারা যদি পরিবেশ দুষণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে তাদের কাজটা কী? শুধু বসে বসে বেতন নেয়া? ঢাকার সড়কগুলো এখন ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। ফুটপাথ দিয়ে হাটতে হলে ময়লা-আবর্জনা ডিঙ্গিয়ে হাটতে হয়। ঝাড়–র নামে শুধুমাত্র রিহার্সেল হয় মাত্র। বাংলাদেশের সরকারি প্রায় সব অফিসের কর্তারা বসে বসে বেতন নিতে আগ্রহী। কাজ করতে, যথাযথ দেগভালে আগ্রহী নয়। বায়ুদূষণ রোধে অনেকগুলো সংস্থা নানা ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত। বায়ুদূষণের কারণগুলো দূর করার বিষয়ে তাদের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কালো ধোঁয়াসহ ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাসে ছড়ানো ফিটনেসহীন মোটরযানগুলোর চলাচল বন্ধ করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার। ঢাকার চারপাশের ইটভাটাগুলোর পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি ও অন্যান্য নির্মাণকাজের সময় ধুলা ওড়ানো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাধ্য করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তাহলে এসব কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ আছে কী?

ধুলা-বালি, শ্বাস কস্ট, শিশুসহ নিরীহ জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী দেশের কতিপয় ধান্দাবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ সেবাদানকারী নামে খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো। রাস্তা কাটলেই টাকা! বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কারোরই কারোর সাথে কাজের কোন সমন্বয় না থাকায় একই রাস্তা বছরে ২/৩ বার কাটা হয়। গবেষণায় যখন প্রকাশ হয়, ‘বায়ুদূষণে শীর্ষের তালিকায় ঢাকা!’ তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে; সিটি কর্পোরেশন কি আছে, নাকি বিলুপ্ত হয়েছে? রাজধানীর সড়কগুলোতে ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন সকালে দুই সিটি করপোরেশন থেকে পানি ছিটানোর নিয়ম রয়েছে। মাঝে মধ্যে পাটি ছিটাতে দেখা গেলেও এটা কোনো সমাধানই নয়; কারণ, পিসডালা সড়কে পানি ছিটানোর ১/২ ঘণ্টা পরই আবার যেই সেই রুপ। পরিবেশ রক্ষায় সরকারের তথা সিটি কর্পোরেশনের কার্যত কোনো টেকসই উদ্যোগ নেই।

আগেতো জীবন তারপর সবকিছু। আমাদের বায়ুদূষণের সমস্যাটি কেনো স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে? এ যেনো ‘বিনা পয়সার’ সদয়, যা সবাইকে ইচ্ছা হোক আর অনিচ্ছায় হোক, নাকে, চোখে, মুখে, শুধু ভোগই নয়, উপভোগও করতে হবে। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা বা রাত কোনো সময়ই, ঘরে বাইরে যার ছোঁয়া থেকে মুক্তি নেই; তা হলোÑ মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর ও স্বাস্থ্যঝুঁকিসম্বলিত দুঃসহ, ভয়াবহ জীবনসংহারী ধুলা আর ধোঁয়া! বহু আগেই বিশেষত ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। দূষণের উৎস নিয়ন্ত্রণে যেমন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, তেমনি জলাশয় সংরক্ষণ ও নতুন করে তা গড়ে তোলারও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার। বর্তমানে রাজধানীর বায়ুর মান এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কট হিসেবে ঘোষণা ও পরিবেশগত ‘জরুরি অবস্থা জারি’ করার সময় হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক গত ১৮ ডিসেম্বর ‘আ ব্রেথ অব চেঞ্জ: সলিউশনস ফর ক্লিনার এয়ার ইন দ্য ইন্দো-গাঙ্গেয় প্লেইনস অ্যান্ড হিমালয়ান ফুটহিলস’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, বিভিন্ন খাত ও প্রশাসনিক পর্যায়ে কয়েকটি নির্দিষ্ট উদ্যোগ একযোগে নেওয়া গেলে দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। এতে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও আরও শক্তিশালী হবে। দক্ষিণ এশিয়ার ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি ও হিমালয়ের পাদদেশ অঞ্চল (আইজিপি-এইচএফ) জুড়ে বায়ুদূষণ স্বাস্থ্য ও উৎপাদনশীলতায় বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনছে। বায়ুদূষণ এখন এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুতর উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। এ অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান।

প্রতিবেদনে এমন কিছু সমাধানের কথা তুলে ধরেছে, যেগুলো সহজেই গ্রহণ করা ও বড় পরিসরে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎচালিত রান্নাব্যবস্থা; শিল্পকারখানার বয়লার, চুল্লি ও ভাটার বিদ্যুতায়ন ও আধুনিকীকরণ; অ-মোটরচালিত ও বৈদ্যুতিক পরিবহনব্যবস্থা; ফসলের অবশিষ্টাংশ ও পশুবর্জ্যের উন্নত ব্যবস্থাপনা; এবং বর্জ্য আলাদা করা, পুনর্ব্যবহার ও নিরাপদ নিষ্পত্তির উন্নত পদ্ধতি।

বায়ুর মান ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর ৩০০ মাত্রার হলে তা দুর্যোগপূর্ণ। গত ১৮ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার ২ স্থানে বায়ুর মান ছিল খুব অস্বাস্থ্যকর। স্থানগুলো হলো দক্ষিণ পল্লবী (২২৭) এবং কল্যাণপুর (২০৮)। বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকরের পরের ধাপ হলো দুর্যোগপূর্ণ। তাহলে আমরা এখন দুর্যোগপুর্ণ অস্বাস্থকর পরিবেশেই বাস করছি। অস্বাস্থ্যকর ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার কারণেই আইকিউএয়ারের পরামর্শ দিয়েছে, বিশেষ কাজে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। বাড়ির বাইরে গিয়ে ব্যায়াম না করার পরামর্শ দিয়েছে আইকিউএয়ার। আর ঘরের জানালাগুলো যতটা সম্ভব বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

বায়ুদূষণ শুধু রাজধানী ঢাকার সমস্যা নয়, এ দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সর্বত্র। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, কোনো কোনো দিন ঢাকার চেয়ে দেশের অনেক বিভাগীয় এবং জেলা এমনকি উপজেলা শহরে দূষণের মাত্রা বেশি থাকে। যেমন- গত ১৮ ডিসেম্বর সকালে উপকূলীয় এলাকা খুলনার দুষণের মাত্রা ২২৪। ঢাকার পাশের জেলা গাজীপুরের বায়ুর মান ২১৫। আর সাভারের বায়ুর মান ছির ১৭৮। পরিবেশ দূষণ সমস্যা নিয়ে আজ সমস্ত বিশ্বই চিন্তিত। সভ্যতার অস্তিত্বই আজ এক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ দূষণ মানব সভ্যতার জন্য ভয়ংকর বিপদের পূর্বাভাস। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যেকোনো মূল্যে পরিবেশ দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

শুধু সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবেনা। অন্তত যার যার বাড়ি, দোকান, কারখানা, ফ্যাক্টরি, অফিসের সামনের যায়গাটুকু পরিস্কার রাখতে হবে। সর্বসাধারণেরও সচেতন হওয়া জরুরি। রাস্তায় যেসব ময়লা আবর্জনা ফেলা হয়, সেগুলোই জীবানু হয়ে আমাদের শরীরে ঢুকছে! যতদিন পর্যন্ত আমরা সৃঙ্খল না হবো, ততদিন আমাদের দেশ পরিচ্ছন্ন হবে না। কেউ কাউকে আলাদাভাবে সচেতন করা সম্ভব নয়। এজন্য থাকতে হবে নীতিমালা ও সুশাসন। যা আমাদের দেশে নেই। নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একে অপরের সাথে মিলেমিশেই সম্ভব সমাজ, দেশ ও পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশ মিডিয়া

বিজ্ঞাপন

রিজার্ভ বেড়ে ৩২.৮০ বিলিয়ন ডলার
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:২৮

আরো

সম্পর্কিত খবর