Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান ও মানুষের জীবন


৪ মে ২০২০ ১৬:১৮

‘ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ডে বসবাসরত বাংলাদেশীরা বিশেষত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আছেন। এমনকি সেখানে স্থায়ী হওয়া অন্য প্রবাসী গোত্রগুলোর তুলনায়ও। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের এ অবস্থা, সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোও এ সত্য স্বীকার করে।’

গবেষণায় এমন সত্য তুলে এনেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক ড. সিতারা পারভীন। আশির দশকের শেষদিকের ওই গবেষণা গ্রন্থাকারে প্রকাশ হয় ১৯৯৭ সালে। ‘এথনিসিটি, কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন’ নামে বইটি প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বিজ্ঞাপন

এই যে, একটা দেশের মধ্যে, এমনকি প্রবাসী গোত্রগুলোর মধ্যেও, সুবিধাপ্রাপ্তিতে এক গোত্র থেকে আরেক গোত্র এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকে, এটা হলো ‘সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান’। ইংরেজিতে বলা হয় ‘সোশাল ডিসট্যান্স’। এখানে ডিসট্যান্স শব্দটি দিয়ে ‘শারীরিক দূরত্ব’ বোঝানো হয় না, বরং ধারণাগত শ্রেণি পার্থক্যকে (ক্লাস ডিফারেন্স) বোঝানো হয়। এই ব্যবধান কখনও বাস্তবিক হয়; আবার কখনও বা অনুভূত বা ধারণাগত বিভাজনও হতে পারে।

রবার্ট এজরা পার্ক ১৯২৪ সালে এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, “মানুষের ক্ষেত্রে ‘ডিসট্যান্স’-এর ধারণাটা শারীরিক দূরত্বের ধারণা থেকে আলাদা।” মার্কিন এ সমাজবিজ্ঞানীর মতে, মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ধরন বোঝা যায় পরস্পরের মধ্যকার বোঝাপড়া ও অন্তরঙ্গতার পর্যায় ও মাত্রা পরিমাপ করে। সমাজ-গবেষকরা ‘ব্যবধান’ ধারণাটি দিয়ে এই মাত্রাকে নির্দেশ করে থাকেন। পার্ক বলেন, “আমরা প্রায়ই এমনটা বলি- ‘ক’ লোকটা ‘খ’-এর খুব ‘ঘনিষ্ঠ’, কিন্তু ‘গ’ দূরের লোক এবং রক্ষণশীল। অপরদিকে, ‘ঘ’ খোলা মনের মানুষ, সহানুভূতিশীল, সহজবোধ্য এবং ‘সহজে যোগাযোগ সাধ্য’। এই সব অভিব্যক্তি সামাজিক শ্রেণি ব্যবধানের কথাই বলছে।”

বিজ্ঞাপন

সমাজবিজ্ঞানী অ্যাশলে ক্রসম্যান ২০১৯ সালে এক প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান হলো অনুভূত অথবা বাস্তবিক ভিন্নতার কারণে সমাজের গোত্রগুলোর মধ্যে বিদ্যমান সামাজিক বিভাজন।’ এই বিভেদ দেখা যায় সমাজের প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে- শ্রেণি, বর্ণ, জাতি, সংস্কৃতি, জাতীয়তা, ধর্ম, লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদি।

এমএমসি থেকে প্রকাশিত ‘জেন্ডার-সংবেদনশীল রিপোর্টিং’ গবেষণা গ্রন্থে লিপন, জামান ও চৌধুরী বলেছেন, ‘জেন্ডার নারী-পুরুষের জন্মগত ও সামাজিক পার্থক্যকে যুক্তিসঙ্গতভাবে চিহ্নিত করে।’ (গুরুত্ব আরোপিত) এই যে নারী-পুরুষের মধ্যে ‘সামাজিক পার্থক্য’, এটাও একটা সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান।
এভাবেও বলা যায়, লোকেরা নিজস্ব সামাজিক গোষ্ঠী বা শ্রেণির বাইরে অন্যদের কতটা গ্রহণ করতে পারে, সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান হলো সেই গ্রহণযোগ্যতার পরিমাপক। একটা গোত্রের লোক যদি ভিনগোত্রের লোককে বা ভিন্নমনাদের গ্রহণ করে তাহলে সেখানে সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান কম। আর যদি গ্রহণ করতে না পারে বা প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে সেখানে সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান বেশি।

বাংলায় কথিত আছে, ‘যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন।’ মানে, এই ন’জনা যে গোত্রেরই হোক না কেন, এদের মধ্যে সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান খুবই কম; সে কারণে ওরা এক সঙ্গে থাকতে পারে, এমনকি সুবিধাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা সে যতোই কম হোক না কেন।

আবার বাংলাতেই কথিত আছে, ‘হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না।’ আঙুলগুলো লম্বায় ভিন্ন ভিন্ন, এখানে সে পার্থক্যের কথা বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, একই মা-বাবার সন্তান হয়েও সহোদরদের মধ্যে ভিন্নতা থাকতে পারে। তেমনি একই সমাজে, বৃহত্তর অর্থে, এক পৃথিবীর মানুষ হয়েও জনে জনে, গোত্রে গোত্রে পার্থক্য আছে।

১৯৪৭ সালে সোশিওমেট্রি সাময়িকীতে ‘মেজারমেন্ট অব পারসোনাল-গ্রুপ রিলেশনস’ প্রবন্ধে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী এমোরি বোগারডাস বলেছেন, ‘এক ব্যক্তির অপর ব্যক্তি সম্পর্কে কিংবা একদল লোকের আরেকদল লোক সম্পর্কে অনুভূত প্রতিক্রিয়া সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান অধ্যয়নের মূল।’
থটকো ডটকমে প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে ক্রসম্যান তিন ধরনের সামাজিক শ্রেণি ব্যবধানের কথা উল্লেখ করেছেন। এক. সংবেদনশীল (অ্যাফেক্টিভ), দুই. আদর্শিক (নরম্যাটিভ) এবং তিন. মিথষ্ক্রিয়ামূলক (ইন্টারেক্টিভ) সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান।

এক গোত্রের একজন ব্যক্তি অন্য গোত্রের কোনো ব্যক্তির প্রতি কতটা সহানুভূতি বা সহানুভূতি বোধ করে, তা-ই হলো সংবেদনশীল সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান। এটা পরিমাপের জন্য একটা মাপনী তৈরি করেছিলেন বোগারডাস। এক গোত্রের মানুষ ভিনগোত্রের কোন লোকের সাথে মিশতে কতটা ইচ্ছুক, তার ভিত্তিতে তৈরি ‘বোগারডাস সোশাল ডিসট্যান্স স্কেল’। এই মাপনী অনুযায়ী, ভিন্ন ধর্মের কোন ব্যক্তিকে বিয়ে করতে চাওয়ার ইচ্ছা সর্বনিম্ন সামাজিক শ্রেণি ব্যবধানকে নির্দেশ করে। অপরদিকে, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কোন ব্যক্তির বাড়ির পাশের বাড়িতে বসবাস করতে না চাওয়ার ইচ্ছা সর্বোচ্চ সামাজিক শ্রেণি ব্যবধানকে নির্দেশ করে।

১৯৩৩ সালে সোশিওলজি অ্যান্ড সোশাল রিসার্চ সাময়িকীতে আ সোশাল ডিসট্যান্স স্কেল প্রবন্ধে বোগারডাস তার মাপনী সম্পর্কে আলোকপাত কনে। সেখানে তিনি এক থেকে সাত পর্যন্ত মাত্রার সামাজিক শ্রেণি ব্যবধানের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো- যাকে বিয়ে করা যাবে, তার সঙ্গে ব্যবধানের মাত্রা ১.০০ (কার্যত কোনো সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান নেই)। এরপর ক্রমান্বয়ে সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান বাড়ে এভাবে- ঘনিষ্ঠ বন্ধু (২.০০); একই পেশায় আমার সহকর্মী (৩.০০); একই মহল্লায় থাকা যারা আমার প্রতিবেশী (৪.০০); পরিচয় আছে কিন্তু যাদের সঙ্গে সেভাবে কথাবার্তা হয় না (৫.০০); যারা আমার প্রতিবেশীর মধ্যেই পড়ে না (৬.০০) এবং আমার দেশের বাইরে যারা থাকে (৭.০০)।

দি আমেরিকান সোশিওলজিস্ট সাময়িকীতে ‘এমোরি বোগারডাস অ্যান্ড দি অরিজিন অব দ্য সোশাল ডিসট্যান্স স্কেল’ প্রবন্ধে ওয়ার্ক ও গ্যালিহার লিখেছেন, এই মাপনী প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। ওই সময় বোগারডাস অবশ্য সামাজিক শ্রেণি ব্যবধানের পাঁচটি মাত্রার কথা বলেছিলেন। ওয়ার্ক ও গ্যালিহারের তথ্যমতে, প্রতিটির জন্য সমকেন্দ্রিক বৃত্ত এঁকে বোগারডাস কম থেকে বেশি ব্যবধানের ক্রম সাজিয়েছিলেন এভাবে- ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু, পরিচিত, আগন্তুক এবং শত্রু।

ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত সংঘর্ষ ও অভিবাসন নীতি নিয়ে সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে বোগারডাস সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান মাপনীটি প্রণয়ন করেন। ১৯১৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ‘বহিরাগত ভূমি আইন’ (অ্যালিয়েন ল্যান্ড ল) পাস করে। তাতে বলা হয়, চীনা, জাপানি, কোরীয় ও এশীয় ভারতীয় অভিবাসীরা সেখানে জমি কিনতে পারবে না এমনকি তিন বছরের বেশি ইজারাও নিতে পারবে না। ১৯২০ সালে অঙ্গরাজ্যটি আরেকটি আইন পাস করে; এর আওতায় অভিবাসী এশীয়রা জমি ইজারা নিতেই পারবে না। এমনকি ১৯২২ সালে মার্কিন সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন, জাপানিরা ‘অ্যালিয়েন’ এবং তারা ‘নাগরিকত্বের জন্য অযোগ্য’।

ক্রসম্যান বলেছেন, সংবেদনশীল সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান কুসংস্কার, পক্ষপাত, বিদ্বেষ এমনকি সহিংসতাকে উস্কে দিতে পারে। তার মতে, বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের ব্যবধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘৃণাবাদী অপরাধ বাড়িয়ে তুলছে।

আরেকটি আছে আদর্শিক সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান। ক্রসম্যানের ভাষায়, এক গোত্রের লোক যখন গোত্র বহির্ভূত লোকজনের সঙ্গে নিজের পার্থক্য অনুভব করে, সেই ব্যবধান হলো আদর্শিক সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান। এ ধরনের ব্যবধানবোধ থেকেই জন্ম নেয় ‘আমরা’ আর ‘তারা’ এবং ‘ঘরের লোক’ আর ‘বহিরাগত’ এসব ধারণা।

সেঁজুতিতে (১৯৩৮) আমরা দেখি, জীবন-জোয়ার শুরুর আগে অগ্রজরা যেমন ‘এ আমাদেরই লোক’ বলে চিনে নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে, কবি তেমনি ‘ভাঁটার গভীর টানে’ জীবনতরী বাইবার সময় অনুজদের কাছে ‘পরিচয়’ দিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘আমি তোমাদেরই লোক’।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’য় (১৯১০) আমরা জাত-গোঁড়ামির চূড়ান্ত দেখেছি: ‘হিন্দু’ বিনয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না ‘ব্রাহ্ম’ ললিতার পরিবার; শেষে কোনো এক সোমবারে ওদের বিয়ে হয়, কিন্তু ললিতাকে তার মা পরিত্যাগ করেছিল।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেবদাসের বাবা-মাকে দিয়ে বুঝিয়েছিলেন বংশ মর্যাদার ব্যবধান। দেবদাস-এ (১৯১৭) কেন্দ্রীয় এ চরিত্রের মা পারু সম্পর্কে বলেন, “দু’জনের বড় ভাব; কিন্তু তাই বলে কি বেচা-কেনা, চক্রবর্তী ঘরের মেয়ে আনতে পারি? তাতে আবার বাড়ির পাশে কুটু’ ছি ছি!” এ কথা শুনে, ‘কর্তা সন্তুষ্ট হইলেন; কহিলেন ঠিক তাই। কুলের কি মুখ হাসাব?’

মিথষ্ক্রিয়ামূলক সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান- ক্রসম্যান বলেছেন, ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের লোকেরা পরস্পরের সঙ্গে কী হারে এবং কোন মাত্রায় যোগাযোগ করে, সেটা পরিমাপ করা যায় মিথষ্ক্রিয়ামূলক সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান দিয়ে। ভিনগোত্রগুলো যত কম মিশবে, মিথষ্ক্রিয়ামূলক সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান তত বেশি। আর যত বেশি মিথষ্ক্রিয়া করবে, সামাজিকভাবে তারা ততখানি কাছাকাছি।

লর্ড সিংহ সম্পর্কে ব্যক্তিপ্রসঙ্গ রচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কিন্তু অন্তরের মানুষ একা, যদি সে আপন মহিমাতেই দেখা দিল তবেই তাকে দেখা যায়। সেই পরিচয়ে কেবলমাত্র দলের লোকের চেয়েও তাকে অনেক বেশি সত্য বলে জানি, আত্মীয় বলে জানি।’

‘জাত হিসেবে… সম্পূর্ণ আলাদা’ চীনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ওই দেশের সঙ্গে নিজদেশের ‘গভীর আত্মীয়তার যোগ অনুভব’ করেছিলেন, কালান্তর-এ যেমনটা লিখেছেন, ‘অত্যন্ত পরের মধ্যেও যে-সত্যের বলে অত্যন্ত আত্মীয়তা স্বীকার করা সম্ভব হয় সেই সত্যের জোরেই চীনের সঙ্গে সত্য ভারতের চিরকালের যোগবন্ধন বাঁধা হয়েছে।’

হ্যাংচোর লেকে ক্যান্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে মিথষ্ক্রিয়া হয়েছিল, আমার দেখা নয়া চীন পড়লেই তা বোঝা যায়, ভিন্ন দুটো পক্ষের মধ্যে সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান কতখানি কমে এসেছিল। আরেকটি নৌকা থেকে ওই শিক্ষার্থীরা ডাক দিলে ‘ভয়ে…জড়সড়ো’ সঙ্গীরা রাজি না হলেও বঙ্গবন্ধু ঠিকই সাড়া দিলেন, তাদের নৌকায় উঠে পড়লেন, আর বললেন, ‘আমার কাছে একটা বইঠা দেন। আমি ভালো নৌকা বাইতে পারি। বৈঠা দিলে বাওয়া শুরু করলাম।’ এ দেখে ‘হতবাক’ শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের বিপরীতে নিজের পরিচয়, রাজনৈতিক দর্শন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ ‘অনেক বিষয়ে আলাপ’ও করলেন বঙ্গবন্ধু।

ক্ষমতা ও সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান- মার্কসবাদী তত্ত্বে সমাজের দুটো স্তর: ভিত্তিকাঠামো (বেজস্ট্রাকচার) ও উপরিকাঠামো (সুপারস্ট্রাকচার)। ভিত্তিকাঠামোয় থাকে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত উপাদান। উপরিকাঠামোয় থাকে আর বাকি সব।

অন হিস্টোরিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম-এ এঙ্গেলস যদিও বলেছেন, ‘না মার্কস আর না আমি কখনই বলিনি’ যে, অর্থনীতি সব কিছুর নিয়ন্তা। কিন্তু এমন সতর্কবার্তার পরেও আজও সমাজের উপরিকাঠামোর মূল নিয়ন্ত্রণ অর্থনীতির হাতেই; সোজা কথা, যাদের হাতে টাকা আছে, তারাই ক্ষমতায় আসীন, তারাই সব ধরনের আধিপত্য বিস্তার করছেন, নিয়ন্ত্রণ করছেন সমাজ- শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, রাজনীতি, আইন, গণমাধ্যম সবকিছুই।
হীরক রাজার দেশের (১৯৮০) রাজ জ্যোতিষীকে বলতে শোনা যায়, ‘লগ্ন তো সম্রাটের হাতে/পঞ্জিকায় কী বলে, কী এসে যায় তাতে।’ এবং ‘রাত্র দ্বিপ্রহর’ বদলে ‘বেলা দ্বিপ্রহরে’ আপন মূর্তি উন্মোচনের লগ্ন ঠিক করেন মহারাজ।

এই চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় নিছক গীতবাদ্য ও ছন্দের মধ্য দিয়ে আধিপত্য কীভাবে সামাজিক শ্রেণি ব্যবধান তৈরি করে তা চিত্রায়িত করেছেন। রাজ সভায় মজুর, চাষা, জনগণদের নিতান্তই প্রবেশ নিষেধ। তারা যে ছা-পোষা মানুষ। নিম্নবর্গের। তারা কেমন করে পারে রাজ দরবারে রাজার সামনে কথা বলতে? এই মনোভাব ফুটে উঠেছে চলচ্চিত্রের দৃশ্যে।

আবার ‘এইসব দিনরাত্রি’তে জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘যাদের আস্তানা ঘর তল্পিতল্পা নেই/হাসপাতালের বেড হয়তো তাদের তরে নয়।’
মুখ বুজে সই কেন- নিয়ন্ত্রণকর্তাদের বৈষম্যমূলক আচরণ মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে সামাজিক শ্রেণি ব্যবধানে সবচেয়ে দূরে থাকা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
দলবদ্ধ আদর্শ ও রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা কিংবা গোষ্ঠীগত রীতি বা আচারের সাথে মিল রেখে মানসিকতা, বিশ্বাস ও আচরণ প্রদর্শন করাকে অনুগামিতা বলা হয়।

সামাজিক মনোবিজ্ঞানী রবার্ট চলডিনি ও নোয়া গোল্ডস্টিন ২০০৪ সালে এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেছেন, ‘অনুগামিতা হলো অন্যের প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মিল রেখে কারো আচরণ পরিবর্তনের ক্রিয়া।’

নিজেদের সম্পর্কে যাদের যৌক্তিকভাবেই উচ্চ ধারণা, তাদের আত্মমর্যাদাবোধ বেশি। যারা নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে সেভাবে বিশ্বাসী নয়, তাদের আত্মমর্যাদাবোধ কম।

এলিয়ট অ্যারনসন দ্য সোশাল অ্যানিমাল (২০০৮) গ্রন্থে বলেছেন, ‘যে সব ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ (সেলফ-এস্টিম) কম থাকে, আত্মসম্মানবোধ বেশি থাকা ব্যক্তিদের তুলনায় দলীয় চাপ সহ্য করার প্রবণতা তাদের মধ্যে বেশি।’

সব কটা ব্যবধান ঘুঁচে যাক না- রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ধর্মের নামে, কর্মের নামে, বৈষয়িকতার নামে, স্বাদেশিকতার নামে, যেখানেই মানুষ মানবলোকে ভেদ সৃষ্টি করেছে সেইখানেই দুর্গতির কারণ গোচরে আগোচরে বল পেতে থাকে। সেখানে মানব আপন মানবধর্মকে আঘাত করে, সেই হচ্ছে আত্মঘাতের প্রকৃষ্ট পন্থা। ইতিহাসে যুগে যুগে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সভ্যতা-বিনাশের কারণ সন্ধান করলে একটিমাত্র কারণ পাওয়া যায়, সে হচ্ছে মানবসম্বন্ধের বিকৃতি বা ব্যাঘাত। যারা ক্ষমতাশালী ও যারা অক্ষম তাদের মধ্যেকার ব্যবধান প্রশস্ত হয়ে সেখানে সামাজিক সামঞ্জস্য নষ্ট হয়েছে। সেখানে প্রভুর দলে, দাসের দলে, ভোগীর দলে, অভুক্তের দলে, সমাজকে দ্বিখণ্ডিত ক’রে সমাজদেহে প্রাণপ্রবাহের সঞ্চরণকে অবরুদ্ধ করেছে; তাতে এক অঙ্গের অতিপুষ্টি এবং অন্য অঙ্গের অতিশীর্ণতায় রোগের সৃষ্টি হয়েছে; পৃথিবীর সকল সভ্য দেশেই এই ছিদ্র দিয়ে আজ যমের চর আনাগোনা করছে। আমাদের দেশে তার প্রবেশপথ অন্য দেশের চেয়ে আরও যেন অবারিত।’

কবির এ কথার এত বছর পরও আমাদের বলতে হচ্ছে, এ দুর্ঘটনা আজও ঘটে চলেছে…।

কিন্তু আমরা আশাবাদী হতে চাই। সাম্যবাদী কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় সেই কাক্সক্ষার কথা বলতে চাই,
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!’

ক্যাপশন:
বোগারডাস মাপনী: মানুষের মাঝে বিদ্যমান শ্রেণি ব্যবধান পরিমাপের জন্য সমাজবিজ্ঞানী এমোরি বোগারডাস একটা মাপনীর ধারণা দিয়েছিলেন। এখানে, ১৯২৪ ও ১৯৩৩ সালে দেওয়া তার ধারণার ওপর ভিত্তি করে সমকেন্দ্রিক সাত বৃত্তে দেখানো হয়েছে এক থেকে সাত মাত্রার স্কেলে কে কত কাছের বা দূরের লোক। অলঙ্করণ: আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগার

লেখকদ্বয়: শিক্ষার্থী, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র:
রহমান, এস. এম. (২০২০)। আমার দেখা নয়া চীন। ঢাকা : বাংলা একাডেমি।

ক্রসম্যান, এ. (২০১৯, জুলাই ৩)। ডেফিনিশনস অ্যান্ড এক্সাম্পলস অব সোশাল ডিসট্যান্স ইন সাইকোলজি। থটকো। www.thoughtco.com/social-distance-3026589। প্রবেশ : ২৪ মার্চ ২০২০।

অ্যারনসন, ই. (২০০৮)। দ্য সোশাল অ্যানিমাল। নিউ ইয়র্ক : ওর্থ পাবলিশার্স।

ওয়ার্ক, সি., ও গ্যালিহার, জে. (২০০৭)। এমোরি বোগারডাস অ্যান্ড দি অরিজিন অব দ্য সোশাল ডিসট্যান্স স্কেল। দি আমেরিকান সোশিওলজিস্ট, ৩৮ : ৩৮৩-৩৯৫। doi.org/10.1007/s12108-007-9023-9। প্রবেশ : ২৮ মার্চ ২০২০।

চলডিনি, আর. বি., ও গোল্ডস্টিন, এন. জে. (২০০৪)। সোশাল ইনফ্লুয়েন্স: কমপ্ল্যায়ান্স অ্যান্ড কসফর্মিটি। অ্যানুয়াল রিভিউ অব সাইকোলজি, ৫৫ : ৫৯১-৬২১। doi.org/10.1146/annurev.psych.55.090902.142015। প্রবেশ : ২৭ মার্চ ২০২০।

লিপন, এস. ইউ., জামান, এম. এম., ও চৌধুরী, এফ. জেড. (২০০৪)। জেন্ডার-সংবেদনশীল রিপোর্টিং। ঢাকা : এমএমসি।

পারভীন, এস. (১৯৯৭)। এথনিসিটি, কালচার অ্যান্ড কমিউনিকেশন। ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মার্কস, কে., এঙ্গেলস, এফ., ও লেনিন, ভি. (১৯৭২)। অন হিস্টোরিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম। মস্কো : প্রগতি প্রকাশন।

বোগারডাস, ই. এস. (১৯৪৭)। মেজারমেন্ট অব পারসোনাল-গ্রুপ রিলেশনস। সোশিওমেট্রি, ১০ (৪): ৩০৬-৩১১। doi:10.2307/2785570। প্রবেশ : ২৬ মার্চ ২০২০।

বোগারডাস, ই. এস. (১৯৩৩)। আ সোশাল ডিসট্যান্স স্কেল। সোশিওলজি অ্যান্ড সোশাল রিসার্চ, ১৭ (১৯৩৩): ২৬৫-২৭১। brocku.ca/MeadProject/Bogardus/Bogardus_1933.html। প্রবেশ : ২৮ মার্চ ২০২০।

বোগারডাস, ই. এস. (১৯২৫)। সোশাল ডিসট্যান্স অ্যান্ড ইঁস অরিজিনস। জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড সোশিওলজি, ৯ (১৯২৫): ২১৬-২২৬। brocku.ca/MeadProject/Bogardus/Bogardus_1925b.html। প্রবেশ : ২৬ মার্চ ২০২০।

পার্ক, আর. ই. (১৯২৪)। দ্য কনসেপ্ট অব সোশাল ডিসট্যান্স অ্যাজ অ্যাপ্লাইড টু দ্য স্টাডি অব রেশিয়াল অ্যাটিচিউডস অ্যান্ড রেশিয়াল রিলেশনস। জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড সোশিওলজি, ৮ (১৯২৪): ৩৩৯-৩৪৪। brocku.ca/MeadProject/Park/Park_1924.html। প্রবেশ : ২৬ মার্চ ২০২০।

করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর