Thursday 05 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আত্মসমর্পণ নয়, বিদ্যানন্দ হয়ে থাকুক চির অনুপ্রেরণার উৎস


৫ মে ২০২০ ১৮:০৩ | আপডেট: ৫ মে ২০২০ ২০:২১
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিদ্যানন্দকে আমরা চিনি এক অসাধারণ দাতব্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে, যারা আর্তমানবতার সেবায় অসামান্য আন্তরিকতা ও সাধ্যাতীত চেষ্টায় এগিয়ে আসে। কিশোর কুমার দাসের প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি এখন সেবায় ও আন্তরিকতায় এক আস্থা ও ভরসার নাম। বিশেষ করে তাদের ‘এক টাকার আহার’ প্রজেক্ট এক অসামান্য মাইলফলক। মাত্র এক টাকার নামমাত্র মূল্যে লাখ লাখ মানুষের কাছে প্রতিনিয়ত খাবার পৌছে দিয়েছে এই সংগঠনটি। অসংখ্য মানুষের সাহায্যে নিখুঁত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পৌছে যাচ্ছে সমাজের অভাবী ও অসহায় মানুষের কাছে।

কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপে উগ্র ধর্মান্ধদের অপপ্রচার চলছে সেই শুরু থেকেই। কয়েক বছর আগে স্বেচ্ছাসেবকরা পথশিশুদের খাবার খাওয়ানোর জন্য রাস্তায় নামলো, তখন প্রচার করা হলো বাচ্চাদের মরা মাংস খাওয়ানো হয়। নইলে অজস্র গরীব বাচ্চাদের ফ্রি খাওয়ানো কীভাবে সম্ভব? এরপর প্রচার করা হলো খাবারের সাথে চেতনানাশক মিশিয়ে বাচ্চাদের ধরে নিয়ে পাচার করে দিচ্ছে এই সংগঠন। কোমলমতি শিশুদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হলো এই প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবকদের ছেলেধরা হিসেবে। এই অপপ্রচারে প্রথম দিকে বাচ্চারা স্বেচ্ছাসেবকদের হাত থেকে খাবার নিতে ভয় পেলেও এখন তারা বিদ্যানন্দের খাবার ভ্যান দেখলে ছুটে আসে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু উগ্র ধর্মান্ধরা সক্রিয় থেকেছে বরাবরের মতই। গত বছর ইফতার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য তারা ছড়াল ইফতারের ছোলার সাথে গো-চনা মেশানো হয়। গতবছর ঈদ-উল-আজহার সময়ে বিদ্যানন্দ থেকে যখন কোরবানীর মাংস বিতরণ করা হল অভাবী-দু:স্থদের মাঝে, তখনও প্রচার করা হয়েছে হিন্দুর সংগঠনের দেয়া এই মাংস খেলে ঈমান থাকবে না। কি নিদারুণ মিথ্যাচার! এর সাথে গত দুই তিন বছর ধরে যুক্ত হয়েছে বিদ্যানন্দ ইসকনের সাথে সম্পৃক্ততার মিথ্যাচার। উদ্যোক্তা কিশোর কুমারের ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে রেখে উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের পরিচালিত বিভিন্ন পেইজে প্রচার চালানো হচ্ছে যে কিশোর কুমার হিন্দুত্ববাদী সংগঠক।

বিদ্যানন্দ ইসকনের সাথে যুক্ত সংগঠন। এবছর এই মিথ্যাচারের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে বিদ্যানন্দের পক্ষ থেকে অভাবী ও অসহায় মানুষদের কাছে সঠিকভাবে যাকাত পৌছে দেবার জন্য বিদ্যানন্দ কয়েকজন ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসা শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ করেছে- যারা এই যাকাত আদায় কার্যক্রম তদারকি করবেন। ফলে ধর্মব্যবসায়ীরা যারা প্রতি বছর জাকাত ও ফিতরার একটা বড় অংশ ধর্মকে পুঁজি করে সাবাড় করতো, তারা আগের সাম্প্রদায়িক কীটদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে চরম মিথ্যাচারে নেমেছে। এসব দেখে শেষ পর্যন্ত বিদ্যানন্দের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান কিশোর কুমার দাস তার নিজের হাতে গড়া সংগঠনের প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গতকাল রাতে বিদ্যানন্দ তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে বিষয়টি জানিয়েছে। যদিও তারা কিশোরের পদত্যাগের কারণ হিসেবে সাম্প্রদায়িক নোংরামির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে সংগঠনের স্বার্থে নতুন নেতৃত্ব তুলে আনবার কথা বলছে, কিন্তু সামান্য ভাবলেই খুব সহজে বুঝতে পারা যায় যে বিদ্যানন্দ এবং কিশোর কুমার ধর্মান্ধদের মিথ্যাচারের সুযোগ না দেবার জন্যই চাচ্ছেন সংগঠনের প্রধান পদে সনাতন ধর্মাবলম্বী কেউ না থাকুক! মনুষ্যত্বের মহান আদর্শে মানুষের জন্য পরিচালিত একটা সংগঠনকে ধর্মান্ধদের হুমকি, আস্ফালন আর মিথ্যাচারের সামনে এভাবে হেরে যেতে দেখাটা কি প্রবল লজ্জার এবং গ্লানির, ভাবতেও কষ্ট হয়।

কিন্তু উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের এই হিন্দুয়ানি প্রচারণা আর হুমকি কিন্তু আজকে নতুন নয়। বাঙালিত্ব এবং বাংলাদেশের যে কোন উদ্যোগ, গর্বের যে কোন পরিচয় এই অন্ধ গোড়া মৌলবাদীদের সবসময়ই মাথাব্যাথার কারণ ছিল। এই উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের জয় বাংলা শব্দে সমস্যা আছে, ধর্মান্ধ পাকিস্তানি সেনারা ও জামায়াতের রাজাকার-আলবদরেরা স্রেফ জয় বাংলা স্লোগান দেবার অপরাধে অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করেছিল একাত্তরে, কিন্তু কারো মুখ থেকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ শব্দটা বের করতে পারেনি, কাতারে কাতারে মরেছে অসম সাহসী মানুষগুলো, কিন্তু জয় বাংলা স্লোগান দিয়েই মরেছে। তো সেই আলবদরের উত্তরসূরী ধর্মান্ধের দল এখনো জয় বাংলা শব্দটা সহ্য করতে পারে না, তাই যতভাবে সম্ভব ট্রল করে নোংরামি করে এই শব্দটা মুছে ফেলতে চায়!

উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের শহীদ মিনারে সমস্যা আছে, বাংলা ভাষা তাদের কাছে হিন্দুয়ানি ভাষা, নাপাক হারাম ভাষা, পাকিস্তান আমলে এভাবেই ভাবা হত, এখনো পাকিস্তানপ্রেমীরা এভাবেই ভাবে। সেজন্যই কথায় কথায় আরবি বা উর্দু শব্দ ব্যবহার করে ভাষায় পবিত্রতা আনার চেষ্টা করে। আর সেই ভাষার জন্য কিছু মানুষ বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়েছে, এটা কল্পনা করবার সাহসও পায় না অন্ধকারের এই জীবেরা। তাই সেই শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত শহীদ মিনার তাদের নোংরা ধর্মদন্ডের উপর বিশাল বিষফোড়া। সেই ১৯৫২ সাল থেকেই উগ্র ধর্মান্ধরা শহীদ মিনার উপর হামলা চালিয়েছে, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চেয়েছে বারবার, কারণ ঐ ইট-পাথরের স্তম্ভের পেছনে যে অসামান্য অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উজ্জ্বল দীপশিখা জাজ্বল্যমান, সেটা সহ্য করবার ক্ষমতা তাদের নেই।

উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবসি গানে সমস্যা আছে, যেহেতু গানের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুতরাং তারা প্রচার করে যে এটা আসলে হিন্দুয়ানি গান, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে হিন্দু লেখা গান চলতে পারবে না বলে হুমকি দেয় তারা! পাকিস্তানী আইয়ুব সরকার তো হিন্দুর লেখা গান বলে রবীন্দ্রসংগীতই নিষিদ্ধ করেছিল, পাকিস্তানপ্রেমীদের উত্তরসূরী ধর্মান্ধরা সে জন্যই বাঙালির গর্ব বিশ্বকবিকে সহ্য করতে পারে না, তার রচনা জাতীয় সংগীতকে সম্ভব হলে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চায়।

ঠিক যেভাবে তারা মুছে ফেলতে চায় অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের পরিচয়। উপরে যা বললাম, সবই তাদের কাছে হিন্দুয়ানি মনে হয়, কাফেরের সংগীত মনে হয়, বিধর্মীদের ষড়যন্ত্র মনে হয়, পুরো বাংলাদেশের জন্মটাই এই ধর্মব্যবসায়ী জিহাদী পাকিস্তানপ্রেমী আলবদরদের বংশধরেরা ভারতের চক্রান্ত হিসেবে প্রচার করে আজও! ধর্মান্ধ পাকিস্তান ভেঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ উদার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার ঘটনাটা তারা সালাফিবাদ আর ওহাবিজমের আদর্শের বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখে, ব্যাক্তিগত ক্ষতি হিসেবে নেয় আর এরজন্য সরাসরি ভারতকে দায়ী করে! ধর্মকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করে যাচ্ছে, ভয়ংকর অবমাননা করে যাচ্ছে এই ধর্মব্যবসায়ির দল নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য। ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু এরাই, সবসময়!

এটা তো নতুন কিছু না। আজকেই বা স্রেফ গত কয়েক বছর ধরে ঘটছে, এমন কিছুও না। অন্ধকারের এই অন্ধ অপশক্তির সাথে আমাদের যুদ্ধটা তো চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। তার মানে কি তাদের এই দাবি মেনে নেবো আমরা? আমার সোনার বাংলা গান পাল্টে উর্দু বা আরবি কোন গান বেছে নেবো? জয় বাংলা স্লোগান না দিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বা তার আপগ্রেডেড ভার্সন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগান দেবো? শহীদ মিনারগুলো ভেঙ্গে বাঙালির মাতৃভাষা উর্দু বা আরবি হিসেবে গ্রহণ করবো? বাংলাদেশের পরিচয় পাল্টে দেশের নাম ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাস্তান রাখবো?

না, আমরা তার কিছুই করিনি। কখনো করবোও না। কিন্তু একমুহুর্তের জন্যও পিছু হটিনি, এখনো মাথা উচু করে ফাইটটা দিয়ে যাচ্ছি। এই উগ্র ধর্মান্ধ পাকিস্তানপ্রেমী সালাফিবাদের অনুসারী জিহাদীদের বিরুদ্ধে বাঙালির জাতীয়তাবাদের এই যুদ্ধটা আজ অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলছে। অসংখ্য অজস্র যোদ্ধা যুদ্ধ করতে করতে হাসিমুখে জীবন দিয়ে গেছেন, সাথে সাথে পেছন থেকে সে জায়গায় দাঁড়িয়েছেন আরেক সহযোদ্ধা। একমুহুর্তের জন্যও যুদ্ধটা থামেনি। অনেক ভাই-বন্ধু-আপনজনদের হারিয়েছি, কিন্তু আমরা পিছু হটিনি। অনেকেই কিন্তু যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে পারেনি, অনেক বিখ্যাত যোদ্ধা আর বীরের দলও আছে যারা সময়ের বিবর্তনে পিছু হটেছে, ধর্মান্ধদের চোখ রাঙানির সামনে নতি স্বীকার করেছে, তাদের কপালে পাকাপাকিভাবে সিল বসে গেছে আপোষকারীর। আর সেই আপোষগুলোর ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা উৎকট উল্লাসে প্রচার করেছে তাদের বিশাল বিজয় হিসেবে, আমাদের দিয়েছে লজ্জা আর গ্লানির যন্ত্রণা।

প্রিয় বিদ্যানন্দ, দয়া করে এই যুদ্ধে আমাদের অসীম অনুপ্রেরণাদায়ী বীরের জায়গা থেকে কাপুরুষতা আর গ্লানির লজ্জা হবেন না। ধর্মান্ধদের হুমকি-ধমকি আর মিথ্যাচারে ভয় পেয়ে মাথা নীচু করে আপোষ করবেন না। আজকে তাদের মিথ্যাচার থেকে বাচতে আপোষ করলে কাল তারা আপনাদের সমূলে নিশ্চিহ্ন করার মিশন নিয়ে নামবে। ধর্মান্ধ শ্বাপদদের সাথে এই যুদ্ধে যারাই ভেবেছে আপোষ করে বেচে যাবে, তারাই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। সুতরাং বিদ্যানন্দ মুসলমানের দেয়া নাম, এর ভলান্টিয়ারদের ৮০ ভাগ মুসলমান, এসব বলে ধর্মান্ধদের আরও জেঁকে বসবার সুযোগ দেবেন না। বরং এভাবে প্রচার করুন যে বিদ্যানন্দ মানুষের জন্য, মানুষকে সাহায্য করবার তৈরি সংগঠন, এই নামটা ধর্মীয় পরিচয়ের উর্দ্ধে একজন মানুষের দেয়া, এখানে যে ভলান্টিয়াররা উদয়াস্ত শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, গরম-ঝড়-বৃষ্টি তুচ্ছ করে এমনকি করোনার মত ভয়ংকর প্রাণঘাতী ছোঁয়াচে রোগে সংক্রমণের আশংকা তুচ্ছ করে কাজ করে যাচ্ছে, ক্ষুধার্থ মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, অভাবীর পাশে দাঁড়াচ্ছে, শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিচ্ছে, বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করছে, দেশের ক্রান্তিকালে জনগণের পাশে সামর্থ্যের সবটুকু নিয়ে হাজির হচ্ছে, তারা কাছে কখনো ধর্মীয় পরিচয়টা মুখ্য ছিল না। তারা কখনো কে কোন ধর্মের সেটা দেখে সাহায্য করেনি। প্রতিষ্ঠাতা কিশোর কুমার দাসকে তার স্বপদে বহাল করুন, তার হাত ধরে বিদ্যানন্দ তৈরি হয়েছে, কিছু ধর্মান্ধের উগ্র আস্ফালন আর নির্লজ্জ মিথ্যাচারের কারণে তাকে সরিয়ে দিয়ে ন্যুজ মেরুদন্ডের পরিচয় দেবেন না।

যদি এই ধর্মান্ধদের সংখ্যা একশ হয়, তবে যেকোন  পরিস্থিতিতে সব ধরনের সহায়তা আর সমর্থনে আপনাদের পাশে থাকা অসাম্প্রদায়িক মানুষদের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে লাখো। দয়া করে তাদের প্রাণের সংগঠন বিদ্যানন্দকে এভাবে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক কীটদের সামনে মাথা নত করতে দেবেন না।

এক টাকায় আহার বিদ্যানন্দ বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর