Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাকালে সাংবাদিকতা ও ‘টেন্স’ এর ব্যবহার


৬ মে ২০২০ ১৪:২৫

১২০ ন্যানোমিটার ব্যাসের একটি অনুজীব। নাম নভেল করোনাভাইরাস। ১২ হাজার ৮৭২ কিলোমিটার ব্যাসের বিশাল পৃথিবীকে স্থবির করে দিয়েছে এই অদৃশ্য অনুজীবটি। ভাইরাসটির থাবায় এখন পর্যন্ত না ফেরার দেশে চলে গেছেন আড়াই লাখের বেশি মানুষ। গোটা বিশ্ব দেখছে এক অণুজীবের নিষ্ঠুর ক্ষমতাকে। পার্থিব জগতের প্রতাপশালী গোষ্ঠীও হিমশিমই খাচ্ছে এই দুর্যোগ মোকাবেলায়।

ভয়ানক এই ভাইরাসের দাপটে ধরাতলে চলছে মহামারী। ঠেকাতে চলছে যুদ্ধ। কিন্তু এ যুদ্ধে কোনো আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার নেই। তাই যুদ্ধের ময়দানে ‘সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবের’ শরীরের এক ফোঁটা রক্তও ঝরছেনা। তবে এ যুদ্ধে জয়ী হতে আছে কৌশল, আছে ঢাল। যে ঢাল শক্ত করে ধরে আছেন সেবাকর্মীরা। তাদের উপাধিও জুটেছে ‘সম্মুখ যোদ্ধা’ হিসাবে। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়।

বিজ্ঞাপন

এদেরকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেও অতি-আণুবীক্ষণিক এবং অকোষীয় অণুজীবটির সংক্রমণ রোধ করা যাচ্ছে না। তবে মানব দেহকোষে ভাইরাসটি যেন বাসা বাঁধতে না পারে সে জন্য কিছু নীতি অবলম্বন করছে প্রতিটি দেশ। ধরিত্রীর বুকে সবচেয়ে দরিদ্রতম রাষ্ট্র পূর্ব আফ্রিকার বুরুন্ডির জন্য যে নীতি, মার্কিন মুল্লুকের জন্যও তাই।

অপরদিকে নভেল করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারে লোকচক্ষুর অন্তরালে কাজ করছেন একদল আবিষ্কারক। যারা বিজ্ঞানের উৎকর্ষকে কাজে লাগিয়ে বুঁদ হয়ে আছেন আরোগ্যকর ঔষধ বানানোর কাজে। নিঃসন্দেহে তারাও যোদ্ধা। তাদের বীরত্বকাব্য ধরাধাম জানবে উদ্ভাবন হবার পর। হয়তো জুটবে নোবেল লরিয়েট। কিন্তু সফলতার দেখা যারা পাবেন না তাদেরকেও ব্যর্থ বলা যাবে না। কারণ তাদের যাত্রাটাও শুরু হয়েছিল ৭৭৯ কোটি মানুষের কথা ভেবেই।

বিজ্ঞাপন

বোধ করি এমন সব খবরের জন্য চেতনাশূন্য অথবা মূর্খরাও গণমাধ্যমগুলোর বার্তার অপেক্ষায় থাকেন। আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত আছে দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও অন্যান্য জাতীয় দুর্যোগে তথ্যপ্রবাহের গুরুত্ব। সে হিসাবে গণমাধ্যমকর্মীরা প্রণোদনার দাবিদার না হলেও রাষ্ট্রের শীর্ষ মহল থেকে বন্দনাগীতির আশাটুকু করা যেতেই পারে।

গত ৩ মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস বলেছেন, একদিকে যখন বিশ্বে ভাইরাসের মহামারী চলছে, তখন ভুল তথ্য, ক্ষতিকর স্বাস্থ্য পরামর্শ এবং উদ্ভট ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ঢেউ ‘মহামারীর মতো’ ছড়িয়ে পড়ছে। সেই মহামারীর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হল মুক্ত সংবাদমাধ্যম, যারা যাচাই করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও বিশ্লেষণ তুলে ধরছেন। এর আগে গত ৬ এপ্রিল কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, লাটভিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র এক যৌথ বিবৃতিতে করোনার সংকটকে কেন্দ্র করে কিছু দেশে স্বাধীন ও মুক্ত সংবাদপ্রবাহে অন্যায় বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

জাতিসংঘের মহাসচিবের সেই কথা যখন বিশ্ব দরবারের গণমাধ্যমে স্থান পাচ্ছে, তখনই লাল সবুজের দেশের গণমাধ্যমগুলোতে দেখা মিলেছে সাংবাদিক কাজলের পিঠমোড়া দিয়ে হ্যান্ডকাফ পড়ানোর ছবি। হাজত খানায় লোহার শিকে বন্দী বাবার পাশে ছেলের ছবি। তার অপরাধটাও আজগুবি, সাংবাদিক কাজল নাকি নিজ দেশেই অনুপ্রবেশকারী!

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর ৩ মে পর্যন্ত ২৬টি দিবস পালিত হয়েছে। তবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে নিখোঁজ হওয়া এক সংবাদকর্মীর ফিরে আসা দিবসটিকে সত্যিই স্মরণীয় করে রেখেছে। সেদিন আবার বিশ্ব হাসি দিবসও ছিল। এমন উদ্ভট কাণ্ডে মুচকি একটি হাসি দিয়ে অন্তত হাসি দিবসের মর্যাদাটাকে রেখেছি আমি।

হয়তোবা করোনা টেস্ট, রোগী শনাক্তকরণ, হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের (ভেন্টিলেটর) সংখ্যা কিংবা পোশাক কারখানা খোলা এবং বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে লেখালেখি, দেশব্যাপী চাল চুরি, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারীরা আমাদের যে অভিশাপ দিয়েছেন সেই অভিশাপের গর্দান হয়তো সাংবাদিক কাজলের ওপর দিয়েই গিয়েছে। শুনেছি, তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনে তিনটি মামলা আছে। অনুপ্রবেশকারী হিসাবে জামিন পেলেও ৫৪ ধারায় লাল দেয়ালের মাঝে ঠিকই যেতে হয়েছে।

আগেই বলেছি জনপ্রতিনধিদের চুরির বিষয়ে। এবার একটি জ্যান্ত উদাহারণ দেই। জামালপুরে ত্রাণের স্লিপ তৈরি নিয়ে সরকারী দল দুটি গ্রুপে বিভক্তি হয়। আর এই বিভক্তি রূপ নেয় সংঘর্ষে। মারধর করা হয় গণমাধ্যম কর্মীদের। ক্ষত-বিক্ষত করা হয় সময় টিভি ও ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির ক্যামেরাকে। সাংবাদিক কাজলকে যে রাতে উদ্ধার করা হয় তার আগের সন্ধ্যার ঘটনা এটি।

ক্ষমতাধারীদের অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি প্রকাশ হবে বলেই হয়তো এমন নিয়তি মেনে নিতে হয় অসঙ্গতির বিপরীতে হাঁটা গণমাধ্যম কর্মীদের। অবশ্য এমন ঘটনা আমাদের কাছে এখন মামুলি বিষয়। সাগর-রুনীর শরীর থেকে বের করা রক্তের অদৃশ্য মানবকে যখন দৃশ্যমান করা যায় না তখন প্রতিনিয়ত নির্যাতিত এসব সাংবাদিকদের রক্ত নিয়ে হোলির উৎসব যে হচ্ছে না সেটাই কম কী!

তবে একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে নয় রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে নিজের বিবেকবোধ থেকে প্রশ্ন জাগে রাজধানী থেকে মফস্বল পর্যন্ত দলকানা সাংবাদিক নেতাদের ভূমিকা নিয়ে। আদর্শচ্যুতিও যে সৃষ্টিশীলতা তাদের কাছ থেকেই দেখছি। শিখছি। তাদের অনুপ্রেরণায় অথবা অনুকরণ করতে গিয়ে আমি কিংবা অনুজরা সেসব নেতাদের সৃষ্টিশীলতাকে শৈল্পিক রূপ দিতে গিয়ে ম্যুরাল অথবা পাঠ্যবইয়ে তাদের জীবনীর স্থান দেবার দাবিতে আন্দোলন করলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না।

তবে লজ্জায় মাথা নত হয় এমন পরিসংখ্যানে। ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ২০২০ সালের সমীক্ষা সূচকে জানায়, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১। আগের বছরের তুলনায় আমরা আরো এক ধাপ পিছিয়েছি। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সবচেয়ে পিছিয়ে।

সব কিছুর শুরু যেমন আছে শেষও আছে। বিশ্বায়নের যুগে বিষাক্ত অণুজীবটি পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহকে যেভাবে জাপটে ধরেছে সেটিও হয়তো বিদায় নিবে। ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে। ইংরেজী গ্রামারের ভাষায় পাস্ট টেন্স (Past Tense) হবে এই মহামারী। আর যুগে যুগে সাংবাদিক নির্যাতন ও গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরাটা প্রেজেন্ট ইন্ডিফিনিট টেন্স (Present Indefinite Tense) হয়েই থাকবে। কারণ, এটাই চিরন্তন সত্য।

আর তেলে ভাজা শব্দ অথবা ছবক শক্তি দিয়ে ক্ষমতাধরদের অনুকম্পন পাওয়া আমাদের সিংহভাগ নেতাদ্বয় সর্বদাই প্রেজেন্ট টেন্স (Present Tense) এবং প্রেজেন্ট কন্টিনিউয়াস টেন্স (Present Continues Tense) হয়েই থাকবেন। এ দুটি টেন্স-ই (Tense) দলদাস কোটার জন্য আজীবন সংরক্ষিত।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

করোনাকালে সাংবাদিকতা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর