Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনা থেকে শেখা— আমাদের জীবন ব্যবস্থার যত ফাটল


২০ মে ২০২০ ১৫:৪১

মহামারী করোনাভাইরাস আমাদের জীবন ব্যবস্থার ফাটল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এসব ফাটল আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হলেও আমরা তা শিখতে পেরেছি করোনা থেকে। আসুন দেখে নেই কী সেগুলো-

১। উন্নাসিকতা ও আপসহীনতা: আমরা আপোসহীন। আদেশ, নিষেধ, উপদেশ শোনা মানে আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়া। ব্যক্তি পর্যায় বলুন, কিংবা সামস্টিক বা সাংগঠনিক পর্যায়ে, নিয়ম অমান্য করতে পারা মানে ক্ষমতা জাহির করতে পারা। তাই ঘরে থাকার নির্দেশ, কিংবা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নির্দেশ শুনতে আমাদের কষ্ট হয়। আমরা বিমান থেকে নেমে বাড়ি যাওয়ার জন্য আন্দোলন করি। কোয়ারেনটাইনে থাকতে অস্বীকৃতি জানাই। চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে যাই।

বিজ্ঞাপন

২। লোক দেখানো আড়ম্বর: আমাদের মাস্ক পরতে মজা লাগে।এটাতে একটি উৎসব উৎসব ভাব আসে মনে হয়। মাস্ক পরে অন্যদের বুঝানো যায় আমি খুব সচেতন। তাই গলায় মাস্ক ঝুলে থাকলেও আপত্তি নেই। মাস্ক আমাদের করোনা তাড়ানোর একমাত্র তাবিজ।

৩। দায়িত্ব নিতে অনীহা: করোনা থেকে মানুষ বাঁচানোর দায়িত্ব একমাত্র সরকারের আর চিকিৎসকের। বুঝলাম সরকারের অনেক ভুল ছিল। ভুল এখনো হচ্ছে। কিন্তু আমি কেন ভুল করছি? আমার দায়িত্ব আমি কেন নিচ্ছিনা? কারণ দায়িত্ব নিলে তো আর প্রলাপ বকার সময় থাকেনা। আমাদের দায়িত্ব একটাই। ভুল ধরা। এই যেমন আমি করছি। আপনার আমার ভুল ধরছি। তেমন আরকি।

৪। সবকিছুকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা: আমেরিকা যেমন মনেকরে সবকিছু সামরিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব, আমরা সেভাবে ভাবি সবকিছু রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব। সবকিছুর সমাধান হতে হবে রাজনৈতিক। মাঠে থেকে কাজ করতে হবে। সংসদ তো একটা ঘর। সংসদে থাকতে আমাদের দমবন্ধ লাগে। এখন করোনার মোকাবিলা করা লাগবে ঘরে বসে। মাঠে থাকা যাবেনা। এ কেমন বিপদ। করোনাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা রাজনীতির বাইরে থাকা চিকিৎসক, গবেষক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, উন্নয়নকর্মীদের উপর আস্থা রাখতে পারিনি। তাদের অংশগ্রহণকে সঙ্কীর্ণ করেছি।

বিজ্ঞাপন

৫। দেরীতে সাড়া দেওয়া: আমাদের অভ্যাস পরীক্ষার আগে সকালে পড়তে বসা। যেকোনো কিছুতে দেরীতে জেগে উঠা। দেরিতে সাড়া দেওয়া। আরে ধুর- এসব আমাদের হবেনা। পুরো ফেব্রুয়ারি মাস গেল করোনা বাংলাদেশে আসবে কি আসবেনা এ গবেষণা করে। আসলে কি হবে তার কোন প্রস্তুতি নেই। মার্চে প্রথম কেইস ধরা পড়ার পর মনে হলো এবার পড়তে বসা উচিত। পড়তে বসতে গিয়ে মনে হলো চা বানানো উচিত। চা বানাতে গিয়ে মনে হল বিস্কুট কিনতে যাওয়া উচিত। এই করতে করতে করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকল। এখন চা বিস্কুট আছে, খাওয়ার সময় নাই।

৬। দেশি সমস্যার বিলাতি সমাধান খোঁজার চেষ্টা: করোনা একইসঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় সমস্যা। আমরা শুধু আন্তর্জাতিক পরামর্শ ও রূপরেখা বাস্তবায়নের কথা ভেবেছি। আমাদের স্থানীয় শক্তি ও সামর্থ্যের কথা ভাবিনি। বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়প্রবণ। এক সময় ঘূর্ণিঝড় মানে ছিল লাখ মানুষের মৃত্যু। আমরা সেই যুগ থেকে বেরিয়ে এসেছি। বাংলাদেশ এক দিনেই একটা পুরো অঞ্চলকে সাইক্লোন শেল্টারে ভরে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ এখন ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে জানে। এই সাংগঠনিক শক্তি আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। আমরা করোনা বুঝিনা, আফাল তো বুঝি? আমরা করোনা বুঝিনা তুফান তো বুঝি? করোনার ক্ষেত্রে আশ্রয়কেন্দ্র নিজের ঘর। এটা কতটা প্রশান্তির একটা ব্যাপার। এটাই আমরা বুঝাতে পারলামনা?

৭। প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা: আমরা সবাই রাজা। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে তথ্য ব্যবস্থার সমন্বয় নেই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে খাদ্য ব্যবস্থাপনার সমন্বয় নেই। ভুল বলা হলো। সব আছে। কাগজে-কলমে। কিন্তু বাস্তবে কেউ কারো সঙ্গে কথা বলেনা। একাই সব করে ফেলবো। আমরা একক শক্তিতে বিশ্বাসী। তাই মাঠের ফসল মাঠেই নষ্ট হলো। স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় বললো ঘরে থাকুন। আর যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ভাবল এতে আমার কী।

৮। অবিশ্বাস: আমরা কাউকে বিশ্বাস করিনা। সরকার বিশ্বাস করেনা নাগরিকে। নাগরিক বিশ্বাস করেনা প্রশাসন কে। বেসরকারি সংস্থা ভাবে দরজা খুললেই না জানি দলিল পত্র সব ফাঁস হয়ে গেল। এনজিও লাভজনক হতে চায় কিন্তু লাভজনক হতে লজ্জা পায়। পাছে লোকে কিছু বলে। এই সঙ্কোচ আর অবিশ্বাসের দৌড়ে কেউ কারো পাশে এসে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারেনি। ভাববেননা বলছি কিছু হয়নি। বলছি যা হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি। টুকটাক একটা দুইটা সামস্টিক কার্যক্রম করোনা সমস্যা মোকাবেলায় কতটুকু ভূমিকা রাখতে সক্ষম সেটা বোধকরি বোঝার ক্ষমতা আমাদের সবার আছে।

৯। কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারা: বাংলাদেশ এমন একটা দেশ যেখানে গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা এতটাই শক্তিশালী যে কখনো কখনো রাষ্ট্রযন্ত্রও সেখানে অচল হয়ে যায়। এই শক্তিটাকে আমরা কাজে লাগাতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে এটা কাজ করেছে নেতিবাচক শক্তি হিসেবে। সব সময় যেমনটা হয়ে থাকে। গ্রামীণ সামাজিক কাঠামো হওয়া উচিত ছিল করোনা মোকাবেলায় আমাদের ফ্রন্টলাইন ডিফল্ট সিস্টেম। কিন্তু এটা এখন হয়ে গেছে ফ্রন্ট লাইন ফল্ট। এই ফাটল না সামলে সামনে যাওয়া সম্ভব নয়।

করোনার সমস্যার সমাধান হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি। আর এতে জিততে হলে আমাদের সামনের দিকে তাকাতে হবে স্পষ্টভাবে। উট পাখির মতো মাটির নিচে মুখ লুকিয়ে থাকলে এ সমস্যা দুর হবেনা। হতে পারে, এই করোনা সমস্যার সমাধান আমাদের রাষ্ট্রীয় ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসবে। হতে পারে সেটাই হবে আমাদের নতুন শক্তি।

লেখক: আন্তর্জাতিক উন্নায়ন গবেষণা ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা সংস্থা ইনোভিশন কন্সাল্টিং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক

করোনা করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর