লকডাউন শেষ কথা নয়, এটাই করোনার শেষ নয়
৩০ মে ২০২০ ২৩:৪৮
আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে কিছু অতিথি আসে যাদের আমরা না পারি আদর যত্ন করতে, না পারি বিদায় দিতে। করোনাভাইরাস নামক দুষ্টু অতিথি অনেকটা সেভাবেই আমাদের দেশে এসেছিল। তারপরের ইতিহাস নতুন করে বলার কিছু নাই। আমাদের সরকার সঠিকভাবে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পেরেছে কি পারে না সে বিষয়ে আলোচনায় যাব না, কারণ তাহলে মহাভারত কিংবা রামায়ণ লিখতে হবে। আমি বরং আমাদের তৎকালীন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলি। বরাবরের মতই জাতিগত ভাবে আমরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলাম নানা বিষয়ে। ধর্ম নাকি বিজ্ঞান, বাড়িওয়ালা নাকি ভাড়াটিয়া, দেশি নাকি প্রবাসী, গুজব নাকি সত্যতা ইত্যাদি। তবে আমার কাছে মোটাদাগে যেটা ধরা দিল তা হল জীবন নাকি জীবিকা?
বাঙ্গালি জাতি বরাবরই রসিক প্রকৃতির। করোনাভাইরাসের কাজ সে করুক, আমাদের রসের কাজ আমরা করে যাব টাইপ একটা অবস্থা। একদিকে জীবিকা নিয়ে মানুষের হাহাকার আরেকদিকে আমাদের সোশ্যাল মিডিয়াতে রস সমান তালেই চলছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার রস নিয়ে কোন আপত্তি নাই। এই দুঃসময়ে লকডাউনে বাসায় বসে রস করে যদি মানসিক ভাবে ভালো থাকা যায়, ক্ষতি কী? তৎকালীন সময়ে নানাবিধ রসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছিল সম্ভবত ‘লকডাউন শেষ হলে কী করবো’? জীবীকার প্রয়োজনে লকডাউন তুলে দিতে সরকার বাধ্য হচ্ছে। লকডাউন শেষ হয়েছে। কিন্তু “লকডাউন শেষ হলে কী করবো” সম্প্রদায় এখন কী করবেন? লকডাউন শেষ হলে যারা ফুচকা খাবেন, কাচ্চি খাবেন, অমুকের বাসায় যাবেন, তমুকের বাসায় নাচবেন তারা কী তৈরি? অভিনন্দন আপনাদের। কিন্তু এই লকডাউন তুলে নেওয়া মানে কিন্তু আমরা বিপদমুক্ত নই। তাই রমজান মাসের সংযম শেষ হলেও করোনাভাইরাসের সংযম কিন্তু শেষ হয়নি। লকডাউন পরবর্তী ইচ্ছেগুলো আর স্বপ্নগুলো তাই থাকুক আরও কিছুদিন সংযম রত অবস্থায়। লকডাউন শেষ মানেই করোনা মুক্তি নয়।
এবার আসুন জীবীকার গল্পে। আমি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করি। সরকারের লকডাউন ঘোষণারও আগে আমরা আমাদের অফিস লকডাউন ঘোষণা করেছিলাম মার্চ মাসের ১৯ তারিখ। সেই থেকে আমরা ‘রিমোট ওয়ার্ক’ বা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নীতিতে কাজ করছি। অর্থাৎ বাসায় বসে কাজ করা। এই কনসেপ্টটা আমাদের জন্য একদম নতুন। প্রথম প্রথম লেজেগোবরে একাকার করেছি কিন্তু ধীরে ধীরে শিখে গেছি ১৪ জন মানুষ ১৪ জায়গায় বসে কিভাবে একটি প্রজেক্টে এর কাজ করতে হয়। না এটা চিরস্থায়ী সমাধান নয় তবে অবশ্যই বিপদকালীন সমাধান। লকডাউন শেষ, সরকার সবকিছু খুলার অনুমতি দিয়েছে কিংবা দিতে বাধ্য হয়েছে। আপনার যদি সুযোগ থাকে ‘রিমোট ওয়ার্ক’ বা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নীতিতে কাজ করার তবে তাই করুন। সরকার সব খুলার অনুমতি দিয়েছে, কিন্তু সবার জন্য বাধ্যতামূলক করেনি। তাই লকডাউন খুললেই টিফিন বক্স হাতে নিয়ে অফিসে দৌড়াবেন না। লকডাউন শেষ মানেই করোনা মুক্তি নয়।
যদি বস কিংবা অফিস কর্তৃপক্ষ আপনার অফিস করা বাধ্যতামূলক করে, তাহলে আর কিছু করার নেই। সেক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করুন। মাস্ক, গ্লাভস, হাত ধোয়ার গল্পে যাবনা, সাবধানতা ও সচেতনতা ছোটবেলায় মিনা আর রাজুই আমাদের শিখিয়েছে। আমরা যখন জীবন-জীবিকা আর রস নিয়ে ব্যস্ত তখন থেকেই করোনা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে আমাদের রক্ষা করার শপথ নিয়েছে সম্মুখযোদ্ধারা। সিনেমা কিংবা কমিক বইয়ের সুপারহিরো নয়- সরকার, ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, সেনা, পরিচ্ছ্বন্নতাকর্মী, কৃষক, ব্যাংকার, সাংবাদিক, স্বেচ্ছায় ত্রাণ বিতরণকারী, স্বেচ্ছায় দাফনকারী সহ অনেক বাস্তবের হিরো এগিয়ে এসেছেন। করোনাযুদ্ধের এই বাস্তবের হিরো, সম্মুখযোদ্ধাদের যুদ্ধটা দয়া করে আর কঠিন করবেন না। যুদ্ধটা এখনো চলছে। লকডাউন শেষ মানেই করোনা মুক্তি নয়।
এসময় সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় গণপরিবহন এর ব্যবহার। গণপরিবহন ব্যবহার করার সময় কিভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবেন এটা নিয়ে চিন্তা করে মাথার চুল ছেড়া ছাড়া আর কোন গতি নাই। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিবেন। শুধু বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মনে রাখবেন, লকডাউন শেষ মানেই করোনা মুক্তি নয়।
চার্টার্ড প্লেন ভাড়া করে দেশ ছেরে চলে যাওয়া নিয়ে ইদানিং অনেক নিউজ চোখে পড়ছে। এটা নিয়েও আমাদের তর্ক-বিতর্ক আর রস চলছে। সে চলুক, বাসায় বিরক্ত হয়ে যাওয়ার চেয়ে তর্ক-বিতর্ক আর রস করা ভাল। যাদের ক্ষমতা আছে তারা পালিয়ে বাঁচতে পারলে বাঁচুক। তর্ক বিতর্ক আর রস করতে করতে নিজেকে প্রশ্ন করুন, চার্টার্ড প্লেন ভাড়া করে দেশ ছেড়ে পালানোর ক্ষমতা আপনার আছে? যদি না থাকে তাহলে তর্ক-বিতর্ক আর রস করতে করতে সাবধান হতে হবে। মনে রাখবেন আমাদের ক্ষমতা ‘বাঁচলেও এই দেশে আর মরলেও এই দেশে’।
লেখক: সিইও, গ্রুপডট