অযাচিত বেহাল দশায় উচ্চবিত্ত
২ জুন ২০২০ ১৯:১৯
চলমান প্রেক্ষাপটে সংক্রমিত মরণব্যাধিটির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখা যাচ্ছে দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও সেই সঙ্গে প্রভাবশালী পরিবারগুলোর একের পর এক সদস্যদের। বাস্তবিক সমাজের শীর্ষের চূড়ায় অবস্থানরত তারা হলেন সেইসব ব্যক্তিবর্গ, যারা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে হরহামেশাই অল্প সাধারণ সর্দি, জ্বর বা গাঁ ব্যথা হলেই সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড কিংবা ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশগুলোতে দৌড়ঝাঁপ করতে অভ্যস্ত।
পরিস্থিতির মারপ্যাঁচে পড়ে, কোনো উপায় না পেয়ে এখন তারা দেশেই বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসা নিতে আর হা-পিত্যেশ করছেন একটি আইসিইউ বেডের জন্য, একটি ভেন্টিলেশনের জন্য; দুঃখের বিষয় হলো সেটাও যে খুব পাওয়া যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। যেখানে এক ভাইয়ের ভেন্টিলেশন খুলে আরেক ভাইকে দেওয়ার মতো বাস্তবতা আমাদের দেখতে হচ্ছে, যেখানে তাদের অগাধ অর্থ-বিত্তের পাহাড় ও জীবন বাঁচাতে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না এখন; তখন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হবে, সেটা ভেবে যে কোনো কুল কিনারা পাওয়া যাবে না, এটাই মনে হয় স্বাভাবিক।
যুগের পর যুগ ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষস্থানীয় এ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ক্রমাগত অসামান্য অবদান থাকলেও, উন্নয়নশীল এই দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নে তাদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা বা অলাভজনক বিনিয়োগের সদিচ্ছা কোনটিই যে কোনোদিন ছিল না, চোখের সামনে একটু একটু করে প্রতিদিনই তা আরও স্পষ্টতর হচ্ছে। আরও খোলাসা করে হয়ত বলা যায়, নেহায়েতই কেবল ব্যাবসায়িক বিনিয়োগের অংশ হিসেবে বেশ কিছু বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও তার সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল হয়ত গড়ে উঠেছে ; কিন্তু সেই বিনিয়োগের বিবেচনায় ছিলো শুধুই মুনাফা আর সেইসঙ্গে বিনিয়োগকৃত লগ্নি তুলে আনার জোর প্রচেষ্টা। সামগ্রিক মানবিকতা, নীতি নৈতিকতার তদুপরি সামাজিক দায়বদ্ধতার বিবেচনাটি বরাবরই উপেক্ষার কাতারেই থেকে গেছে। এমনকি তার ধার কাছ দিয়ে পা মাড়াতে দেখা যায়নি এ যাবতকালে কোনো ধনাঢ্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে।
কল্পনায় থাকতে ইচ্ছে করে, জনস্বাস্থ্যের প্রতি আজ যদি এ গোষ্ঠীর গুটিকয়েকের ও সম্মিলিত নিঃস্বার্থ অবদান থাকতো; তাহলে এতটা অগোছালো, এতটা অক্ষমতা আর অব্যবস্থাপনায় রুগ্ন আমাদের বর্তমান স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশাটির কবলটি থেকে মুক্ত থাকতে পারতেন দেশের একটা অংশের জনগণ। আর অন্তত তারা তো পারতেনই।
‘নিউ নরমাল’ এর আত্মঘাতী পথচলা:
জীবন, নাকি জীবিকা; এই প্রশ্নে জীবিকার তাগিদেই অবশেষে সুদীর্ঘ ৬৫ দিনের সাধারণ ছুটির বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে ‘নিউ নরমাল’ এ আসলো দেশ। খুলে দিতে হলো অফিস-আদালত, হাটবাজার, স্টক মার্কেট গনপরিবহন; এককথায় সবকিছুই। ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো নগরগুলো ফিরে পেতে শুরু করেছে তাদের জনাকীর্ণ আর যানজটপূর্ণ হতবিহবল চিরাচরিত রূপ।
এখন শংকার বিষয় হলো, এমতাবস্থায় সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখী। এপ্রিলে যা ৯ দশমিক ৫ শতাংশ ছিল মে মাসের শেষে তা ২১ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। শুধু তাই নয়, সিএনএন’র সর্বশেষ তথ্যমতে সংক্রমিত ব্যক্তির তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ২১তম; মাত্র এক মাস আগেই যা ছিল ১২২তম এবং বর্তমান সংক্রমিতের সংখ্যা ও ৫০ হাজার ছুঁয়েছে। সে যাইহোক, এতসব তথ্য উপাত্তের ঊর্ধ্বগতির তখনকার হিসাবের কথা বলছি, যখন দেশজুড়ে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে সুদীর্ঘ লকডাউন তথা সাধারণ ছুটি চলছিল।
চরম ঘনবসতির এই দেশটিতে লকডাউনকালেই একটা বড় অংশের জনগণকে সামাজিক দূরত্ব, কোনোরকম স্বাস্থ্যবিধি কিছুই জোরপূর্বক আইন প্রয়োগ করেও মানানো যেখানে সম্ভব হয়নি; আর এখন তো সীমিত আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তা নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলে খুলেই দেয়া হলো সবকিছু। অথচ সীমিত আকারের মডেলটি কী আমরা জানি না। সব কিছু খুলে দেওয়া মানে, পরিস্থিতি কি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া? মহামারি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়ে গিয়েছে, তাই কি?কোভিড-১৯–এর করালগ্রাসে বিপর্যস্ত ১৭ কোটি নাগরিককে আরেকবারের মতো একটা নিশ্চিত আত্মঘাতী পথে ঠেলে দেওয়া ছাড়া এ সিদ্ধান্তকে আর কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। অনেক মানুষই বুঝতে পারছে না, এখন সত্যিই কী হতে চলেছে। তবু সরকার সিদ্ধান্ত নিলো। শাসক কি কখনও শাসিতদের কাতারে নিজেকে আবিষ্কার করে? তারপরও বলবো, এই ব্যাপক মৃত্যুর মুখে মানুষকে ঠেলে দেওয়ার অধিকার আমরা রাষ্ট্রকে দিইনি। এই ক্ষতির চেয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বড় হতে পারে না। বরং নিয়ন্ত্রণহীনভাবে রোগের সংক্রমণ বাড়তে দিলে অচিরেই ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বেশি ঝুঁকি ও ক্ষতির মুখে পড়বে।
হাস্যকর শোনালেও বাস্তবতার নিরিখে ব্যাপারটা তাহলে শেষমেশ অনেকটা এরকমই হয়ে গেল; ‘মহামারীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি হয়ে যুদ্ধ করতে হবে, আক্রান্ত হওয়ার মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে’! এভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। কোনোভাবেই সাহস এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস হারানো চলবেনা।
রেস্তোরাঁ’র বুফেতে কিংবা কোনো দাওয়াতে গিয়ে প্রচুর খাবার সামনে পেলে যেমন একসময় খেতে খেতে আর খাওয়ার রুচি থাকেনা, হার্ড ইমিউনিটি’র বিষয়টা অনেকটা এরকম কিনা, তা আমি নিশ্চিত নই। হয়তবা প্রচুর সংক্রমিত হতে থাকবে, হতে হতে এক পর্যায়ে ভাইরাসটি নিজেই তার সংক্রমিত করার ক্ষমতাটি হারাবে। ততদিনে হয়ত জীবন থেকে হারিয়ে যেতে পারেন আমার আপনার অনেক আপনজন।
বিশ্বের সব দেশ যখন ‘হার্ড ইমিউনিটির’ পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে, তখন আমরা ঠিক সেই দিকেই ধাবিত হচ্ছি। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চক্ষু বিশেষজ্ঞ মোদাচ্ছের আলী বলেছেন, ‘এখন সব কিছু খুলে দিলে স্বাস্থ্যব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে এবং আমরা হার্ড ইমিউনিটির দিকে যাব।’ কিন্তু এই হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের বিষয়টিও খুবই অস্পষ্ট। এযাবৎ কোনো সংক্রামক ব্যাধির জন্য টিকা ছাড়া হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করার নজির নেই।
এর বাইরে কোনো উপায় এখন কি আর আমাদের আছে?
প্রবাদ আছে; মানুষ নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারে,কিন্তু পায়ের বদলে সেই কুড়ালটা এবার আমরা নিজেদের কপালেই মেরে দিলাম কিনা? সেটার উত্তর আমাদের কারোরই এখনও জানা নেই।
লেখক: চার্টার্ড একাউন্টেন্ট এবং আর্থিক বিশ্লেষক, কানাডার টরন্টো শহর থেকে।