ভাওয়াল গড়ের ধ্বংসগাঁথা, বনবিভাগের দায় কতখানি?
৪ জুন ২০২০ ২১:২৫
অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ন, শিল্প ও কল-কারখানা স্থাপন এবং পরিবেশ দূষণের কারণে গাজীপুর ভাওয়াল অঞ্চলের বন ও প্রকৃতি হুমকির মুখে। ভাওয়াল গড়ের ধ্বংসগাঁথা এক কথায় মর্মান্তিক। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে গাজীপুর জেলা রাজধানী ঢাকার পাশে এবং শিল্প-কারখানা স্থাপনের উপযোগী উঁচু ভূমি। শিল্প উদ্যোক্তারা বনের ভেতর অল্প জমি কেনার পর কয়েক গুণ বেশি বনের জায়গা দখল করে প্রকৃতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্থাপনায় কারখানা গড়ে তোলেন।
প্রায়ই শোনা যায়, বনের জায়গা বেহাতের সঙ্গে প্রভাবশালী মহল ও বনকর্মীরা জড়িত। আর এসব কারখানার অপরিশোধিত বিষাক্ত তরল বর্জ্যের গন্তব্য উন্মুক্ত জলাশয়। কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানি প্রকৃতিক জলাশয় তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালুনদী ও মাছের ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত বেলাই বিলকে নিয়ত দূষিত করছে। উন্মুক্ত এসব জলাশয় এখন জলজ প্রাণীশূন্য।
পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আইন-কানুন, বিধি এবং নীতিমালার মজবুত কাঠামো রয়েছে। সরকার ১৯৯২ সালে পরিবেশ নীতি, ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৭ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা এবং ২০০০ সালে পরিবেশ আদালত বলবৎ করে। ২০১০ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সংশোধন ও হালনাগাদ করে সরকার। পরিবেশ আদালত আইন ২০১০ জারি করে পরিবেশ অধিদফতরের পাশাপাশি পরিবেশ দূষণকারী যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার অধিকার জনগণের কাছে অর্পণ করা হয়েছে। এছাড়া দেশের বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালের জাতীয় বন নীতি জারি রয়েছে।
সামাজিক বনায়নকে উৎসাহিত করে প্রাচীন এই বনকে বাঁচিয়ে রাখার আন্দোলনে পরিবেশবাদীরা তথা সচেতন দেশবাসী সোচ্চার। বনের জমি দখল এবং বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় গাজীপুরের বনে এখন আর আগের মতো বন্য পশু ও পাখি দেখা যায় না। তাই কয়েক বছর ধরে দাবি উঠেছে, ‘বন্য প্রাণী বাঁচাতে আগে বাঁচাই বন’। আমাদের দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত কার্বন যৌগের ব্যবহার, বৃক্ষনিধন, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ মানবসৃষ্ট নানাবিধ কারণে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। জনগণকে সচেতন করতে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করে আসছে। আর এদিকে দেশব্যাপী বনাঞ্চলের সুরক্ষা এবং বৃক্ষরাপণের সরকারি- বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও গাজীপুরের বন ও বনভূমি বেহাত হচ্ছে প্রতিদিন।
এ বিষয়ে কথা হয় পরিবেশ অধিদফতর গাজীপুর কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তারা মনে করেন, পরিবেশ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট থাকলে জরিমানা আদায়ের পরিমাণ আরও বাড়ত। জেলায় ছোট-বড় ১০ হাজারের বেশি শিল্প-কারখানার কার্যক্রম তদারকি করতে আরও বেশি জনবল দরকার। বনের জমি বেহাত ও প্রকৃতি ধ্বংস, জলাশয় ভরাট এবং কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে জলজ প্রাণী বিলুপ্তিসহ পরিবেশের ক্ষতি এবং ক্ষতি হতে পারে— এমন অভিযোগে মামলা করেও সুফল মিলছে না। জলাশয় ভরাট এবং পরিবেশ দূষণসহ নানা অভিযোগে গাজীপুরের বিভিন্ন থানায় পাঁচটি মামলা দায়ের এবং আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে আদালত চার্জ গঠন করার পর দু’টি মামলা অভিযুক্তরা গাজীপুর থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করে।
পরিবেশ অধিদফতর গাজীপুর অফিসের পরিদর্শক শেখ মুজাহিদ বলেন, মামলা স্থানান্তর হয়ে গেলে আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের তথ্য, শিল্প অধ্যুষিত এই জেলায় পরিবেশ দূষণ রোধ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় দ্রুত সুফল পেতে বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন।
পরিবেশ অধিদফতর গাজীপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুস ছালাম সরকার মনে করেন, দেশের অনেক জেলার চেয়ে গাজীপুরে শিল্প-কারখানা বেশি এবং পরিবেশ সুরক্ষার কাজও বেশি। ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজার পরিমাণ সীমিত। বেশি পরিমাণ পরিবেশ আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ফাইল বা নথি ঢাকায় পাঠিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে সময়ক্ষেপণ হয়। বিভাগীয় পরিচালকের কার্যালয় স্থাপন সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।
টেকসই উন্নয়নে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ সময়ের দাবি। বনকর্মীরা বনরক্ষায় সচেষ্ট নন— এমন অভিযোগও দীর্ঘদিনের। বনের জমি উদ্ধারে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে বলে কথিত আছে। গাজীপুরে কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য ফেলে পরিবেশ দূষণ, জলাশয় ভরাটসহ নানা অভিযোগ অহরহ।
প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় গাজীপুরে পরিবেশ আদালত স্থাপন করা দরকার। একইসঙ্গে বন আইন ১৯২৭-কে সংশোধন করে যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
ছবি: ঢাকা বন বিভাগের মনিপুর বিট অফিসের কাছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে পলাশ খাবার হোটেলের পেছনে টিন দিয়ে ঘিরে গজারি গাছ মেরে ফেলছে দখলদাররা