অঘটন ঘটার পরই কেবল আমরা দুর্বলতা খুঁজে পাই!
৯ জুন ২০২০ ১৬:২৪
গত ২৭ মে রাতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যকেন্দ্র ইউনাইটেড হাসপাতালের বর্ধিত অংশে অগ্নিকাণ্ডে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। এই বর্ধিত অংশটি স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যকেন্দ্র কর্তৃপক্ষরা করোনা আইসোলেশন ইউনিট হিসেবে স্থাপন করেছিলেন। সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে— ইউনাইটেড হাসপাতাল তাদের করোনা ইউনিটের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে অনুমতি নেয়নি। এমনকি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়াতে হলে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন হলেও সেটিও নেওয়া হয়নি। হাসপাতালের স্থায়ী কাঠামোর বাইরে করোনা ইউনিট স্থাপনের জন্য অনুমোদনহীন বর্ধিত অংশে করোনা আইসোলেশন সেন্টার তৈরিতে যে সকল মানদণ্ড ও নিয়মকানুন অনুসরণ করা দরকার তার সবকিছুই ভঙ্গ করা হয়েছে বলেও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই যে এত অনিয়ম করে স্পর্শকাতর সময়ে ইউনাইটেডে করোনা ইউনিট স্থাপিত হয়েছিল, তা জানা গেল একটি মর্মান্তিক ঘটনার পর !
অগ্নিকাণ্ডের পর স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যকেন্দ্র ইউনাইটেড হাসপাতালের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার বিষয়ে যে ব্যাখ্যা ও তথ্যপ্রদান করা হয়েছে— তা রীতিমতো অমানবিক, অপেশাদার ও অনৈতিক। তারা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিজেদের দায়িত্বহীনতা, পদক্ষেপহীনতা এবং অবহেলাকে আড়াল করে ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুকে সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ দিতে চেয়েছে।
প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, ইউনাইটেডের কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান ডা. সাগুফা আনোয়ার দাবি করেছেন, ‘রোগীরা সবাই লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।’ অর্থাৎ যান্ত্রিকভাবে বাঁচিয়ে রাখার অবিরত চেষ্টায় থাকা রোগীদের স্থানান্তর করার সুযোগ না থাকায় এই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এবং এটিই যেন স্বাভাবিক পরিণতি ! তা ছাড়া যান্ত্রিকভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় থাকা রোগীরাও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু করার ক্ষমতাহীন— ফলে এমন অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই! যদিও নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তাদের মৃত স্বজনরা লাইফ সাপোর্টে ছিলেন না। এমনকি আইসোলেশনে থাকাদের মধ্যে ২ জন করোনা নেগেটিভ ছিলেন। ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষের এ ধরনের বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তারা অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডকে একটি অপ্রতিরোধ্য-আকস্মিক দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মিথ্যাচার করেছে।
করোনাকালীন সরকারি ও বাণিজ্যিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার চিত্র আমরা গত কয়েক মাসে ভালোভাবেই অবগত হয়েছি। সর্বশেষ আগুনে পুড়ে রোগীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক স্বাস্থ্যসেবার চিত্র আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে— এ ধরনের হাসপাতালগুলো আলো ঝলমলে বিলাসবহুল আবাসিক ভবন মাত্র ! এখানকার বর্ধিত অংশ নিরিবিলি অবকাশ যাপনের তাঁবু! এখানে চিকিৎসাসেবা ও রোগী ব্যবস্থাপনায় আন্তরিকতা-নৈতিকতা- পেশাদারিত্ব কোনোটিই নেই। যদিও বাণিজ্যিক স্বাস্থ্যসেবায় মুনাফা ভাবনার বাইরে পেশাদারিত্ব ভাবনা আদৌ আছে— এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। কেননা টাকা পরিশোধ করতে না পারায় রোগীকে জিম্মি করা, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও দিনের পর দিন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রাখা, মৃত রোগীকে লাইফ সাপোর্ট কিংবা আইসিইউতে নিতে হয়েছে বলে বাড়তি টাকা আদায়, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, নবজাতক চুরি হওয়া, টাকা জমা দিতে দেরী হওয়ায় চিকিৎসা শুরুতে বিলম্বের কারণে রোগীর মৃত্যু— এমন অনেক অমানবিক ঘটনার সংবাদ সকলেরই জানা। আবার এমনটিও নয় যে, সরকারি সেবাকেন্দ্র আন্তরিকতা-নৈতিকতা-পেশাদারিত্বে পরিপূর্ণ !
করোনার মতো কিংবা এর কাছাকাছি কোনো মহামারি বাংলাদেশ এর আগে কখনও মোকাবিলা করেনি। সে কারণেই হয়তো স্বাস্থ্যখাতের স্বেচ্ছাচারিতা, অবহেলা-অপেশাদারিত্ব, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি কতটা প্রকট হতে পারে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়নি। করোনার এই কালে যা প্রকটভাবে ধরা দিয়েছে। শুধুমাত্র করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ডেজিগনেটেড কোভিড ও নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে রোগীর সেবা বঞ্চণার বহু ঘটনা ঘটেছে। একটি মহামারি পরিস্থিতিতে সেবা প্রদানে অনীহা এবং সেবাদানকারীদের নিরাপত্তা উপকরণ ক্রয়-সরবরাহে অব্যবস্থাপনা, অর্থ অপচয় কিংবা লোপাট হওয়ার সংবাদের ছড়াছড়ি। সেবা বঞ্চণা নিয়ে সরকার প্রধান সেবাদানকারীদের উদ্দেশ্যে কঠোর বার্তা দিলেও সেবা ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশিত মাত্রা অর্জিত হয়েছে— এমনটি হলফ করে বলা যায় না। রাষ্ট্র-রাজনীতি-সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির মালিকানাধীন একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে করোনা সন্দেহে রোগীকে বের করে দেওয়ার পর চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে মৃত্যুর কাছে সেই রোগীর পরাজয়ের ঘটনাও আমরা জেনেছি।
সে যাই হোক, প্রসঙ্গ যেহেতু অগ্নিকাণ্ড এবং ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু— সে কারণে আপাতত ইউনাইটেড ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের “অবহেলা জনিত” হ্ত্যাকাণ্ডের দায় নিয়েই আলোচনা করতে চাই। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যকেন্দ্র ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ— ১) অনুমোদনহীন ও বিধি বহির্ভুতভাবে করোনা আইসোলেশন ইউনিট চালু এবং সেখানে আদর্শমান অনুসরণ না করে এবং অননুমোদিত উপকরণ দিয়ে লাইফ সাপোর্ট ইউনিট স্থাপন করে; ২) অগ্নিকাণ্ডের সময় আইসোলেশন ইউনিটে থাকা ৫ জনকে উদ্ধারে কোনো প্রকার উদ্যোগ বা ব্যবস্থা না নিয়ে; ৩) আইনানুযায়ী আইসোলেশন ইউনিটের জন্য সার্বক্ষণিক ডাক্তার, নার্স ও সহযোগী কর্মী নিয়োজিত না রেখে; ৪) যথাযথ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ও নির্বাপণকারী নিয়োগ না করে অপরাধ সংঘটন করেছে, যা দণ্ডবিধি আইন অনুযায়ী অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড এবং মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিনেন্স ১৯৮২ লঙ্ঘন হিসেবে বিচারযোগ্য।
অপরদিকে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর— ১) মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিনেন্স ১৯৮২ অনুসরণে মহাপরিচালকের পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি তথা বিধিসম্মতভাবে পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ইউনাইটেডের অনিয়ম সংশ্লিষ্টতায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে এবং নিয়ন্ত্রণকারীর অপরাধজনক উদাসীনতায় ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ পাওয়ায় অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডে সহায়তা এবং ২) নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে পেশাগত দায়বদ্ধতা পালন না করে অপরাধ সংঘটন করেছেন। এ ছাড়াও অবকাঠামো ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনায় নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে যথাক্রমে রাজউক এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা হলে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অনিয়ম নজরে আসত, যা এই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতো। ফলে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যৌথ অবহেলা ও দায়িত্বহীনতায় উদ্ভুত অপরাধ হিসেবেই স্বীকৃত। অপরাধের এই চিহ্নিত প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে বিভাগীয়সহ বিচারিক ব্যবস্থাপনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আবশ্যকতা রয়েছে।
যে কোনো অপরাধের বিচার, তা বিভাগীয় কিংবা বিচারিক যে পন্থাতেই করা হোক না কেন, এ জন্য অপরাধী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিতে হয়। সেদিক থেকে গত ২৭ মে রাতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যকেন্দ্র ইউনাইটেড হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে ৫ জনের মৃত্যুতে ইউনাইটেড, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, রাজউকসহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে— ভবিষ্যতে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা রোধে যার কোনো বিকল্প নেই।
পূর্বাপর অনেক ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায় যে, অন্যান্য অনেক খাতের মতো স্বাস্থ্যখাত কতটা নাজুক! আমাদের দুর্ভাগ্য অঘটন ঘটে যাওয়ার পরই কেবল আমরা দুর্বলতা খুঁজে পাই ! ইউনাইটেডের অগ্নিকাণ্ডের পরও তাই ঘটেছে। সেবাখাত হিসেবে স্বাস্থ্যখাতের যথাযথ ব্যবস্থাপনায় যুগপোযোগী আইন ও এর কার্যকর প্রয়োগ প্রয়োজনীয় হলেও— দুটি ক্ষেত্রেই অপর্যাপ্ততা বিদ্যমান। এ অবস্থায় নতুন আইন প্রণয়ন কিংবা ১৯৮২ সালের আইনটির প্রয়োজনীয় সংস্কার করে জনগণের প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যখাত গঠন করতে হবে। একইসাথে অগ্নিকাণ্ডে ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ও তৎপরবর্তী কার্যক্রমে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যকেন্দ্র ইউনাইটেড হাসপাতাল এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসহ রাজউক এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের দায়িত্বহীনতা, অবহেলা-অপেশাদারিত্বের কারণে সংঘটিত অপরাধসমূহ সুনির্দিষ্ট করে সকলের বিচার করতে হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না স্বাস্থ্যসেবা জাতি গঠনের অন্যতম খাত। এই খাত বাণিজ্যিক পরিসরে চলতে পারে না— এমন ভাবনায় বিকশিত স্বাস্থ্যখাতই কেবল জনগণের প্রত্যাশিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে— আমরা বিশ্বাস করি, ‘কোনো রোগী বা মানুষই— পুড়ে কিংবা বিনা চিকিৎসায় মরবার অধিকার নিয়ে জন্মায়নি।’
লেখক : অ্যাক্টিভিস্ট ও আইনজীবী