হারিয়ে যাওয়া পেশা আর শ্রমিকের ভবিষ্যৎ
২ জুলাই ২০২০ ১৯:০৭
যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলাতে না পারায় অনেক পেশাজীবীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। নদীপ্রধান এলাকার বাসিন্দা হওয়ার কারণে যাত্রীবাহী নৌকার মাঝিদের সাথে আগে নিয়মিত সম্পর্ক রাখতে হতো। এদিক-সেদিক যেতে হলে মাঝি ও নৌকা ছাড়া উপায় ছিল না। সেই নৌকা ও মাঝি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রতিমাসে ৫-৬ মণ ধানে একজন শ্রমিক বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত গৃহস্থবাড়িতে থেকে কাজ করতো। এই শ্রমিকদের এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। পায়ে চালিত প্রেসে ছাপানো হতো পোস্টার, হাতে লেখা হতো ব্যানার। এখন সব হয় অটোমেটিক মেশিনে। প্রত্যেকটি অফিসের সামনে আগে টাইপ মেশিন নিয়ে অনেকে বসতো। ফ্যাক্স-ফোনের ব্যবসার পেশা মাত্র এক যুগ আগেও রমরমা ছিল।
এভাবে শহরগুলোতেও শ্রম বিক্রয়ের ধরনের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বহু পেশা হারিয়ে গেছে। করোনার কারণে ফুটপাথের চা নাশতার ব্যবসা লাটে উঠতে যাচ্ছে। পায়ে চালিত রিকশা এখন যন্ত্রচালিত হয়ে গেছে। রিকশার পরিবর্তে মোটরসাইকেল বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
একসময় রিকশা হয়তো থাকবেই না। পরিবেশ ও যানজটের জন্য রিকশা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পরিবর্তিত এসব পেশার পেশাজীবীদের অনেকেই দিনে দিনে বেকার হয়ে পড়ছে। অনেকে সরকারি ও এনজিওর সহযোগিতা ছাড়াই নিজে থেকেই পরিবর্তন করছে পেশা।
রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, দিনমজুর, হকার, ফুটপাথের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী ও এরকম শারীরিক শ্রমপেশার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের যদি সামাজিক ও সরকারি উদ্যোগে অন্য কোনো পেশায় স্থানান্তরিত করা যেত তবে সমাজ থেকে ছোটখাটো অপরাধ কমে যেত। নেশা, যৌনতা, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ সমাজ থেকে কমে যেত। ভ্রাম্যমাণ শ্রমিকদের ও অশিক্ষিত বেকারদের জীবন ও সংসার হতো নিরাপদ। মাস শেষে নির্দিষ্ট বেতন বা ভাতা পেলে এদের মাস চলার একটা হিসাব স্বামী-স্ত্রী মিলে ঠিক করে ফেলতে পারতো। সামাজিক শৃঙ্খলার আওতায় এরা নিজে থেকে আটকে যেত।
ভাসমান শ্রমিকরা একদিন বেশি আয় করলে খুচরা বিনোদন করে বাড়তি টাকাটা খরচ করে ফেলে। তাদের কাছে যেগুলো বিনোদন তার বেশিরভাগ সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় বরং সামাজিক অপরাধ। এদের মাসে এককালীন আয় না থাকায় বাসাভাড়া দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যার জন্য বস্তিতে এদের আগ্রহ বেশি থাকে। অনিশ্চিত উপার্জন এদের সন্তানদের নিয়মিত পড়াশুনা থেকে ঝরিয়ে ফেলে।
আজকে হয়তোবা বৈদেশিক চাহিদা ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়া যুগোপযোগী করতে পাটকল বন্ধ করা ছাড়া সরকারের হাতে বিকল্প পথ নেই। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর উচিত ছিল আরও আগে থেকেই স্বল্প আয়ের পাটকল শ্রমিকদের জন্য বিকল্প শ্রম ও আয়ের পথ তৈরি করে পাটকল বন্ধ করা। স্বল্প আয়ের মানুষদেরও পরিবার, সন্তান, পড়াশুনা, ভবিষ্যৎ রয়েছে। তাদের আগেই একটা বিকল্প শ্রম ও আয়ের পথ খোলা রেখে ছাঁটাই প্রক্রিয়াটা শুরু করা উচিত ছিল।
ভবিষ্যতে মুক্ত শ্রমিকদের হঠাৎ করে আয়ের পথ নিষিদ্ধ করার আগে এদেরকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। যেমন প্রতিটি শহরের ভাসমান শ্রমিকদের একটি নির্দিষ্ট নিয়মে নিবন্ধন প্রক্রিয়া করা যেতে পারে। তারপর এদের পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাকিদেরকে সংসার চালানোর জন্য বেকার শ্রমভাতার আওতায় এনে ভাসমান শ্রমিকদের (দিনমজুর ও রিকশা, ভ্যান চালক) মাস মাইনে চাকরির সন্ধান ও সেই সাথে প্রশিক্ষণ দিয়ে উচ্চমানের শ্রমিক হিসেবে তৈরি করে দেশে-বিদেশে কাজে লাগানো যেতে পারে। এভাবে রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি ও এইরকম শারীরিক শ্রমনির্ভর বাহন মুক্ত করা যেতে পারে দেশের সব শহরে। এসব শ্রমিকের জন্য ফান্ড তৈরির জন্য একটি বোর্ড গঠন করে আমাদের দেশের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কযুক্ত দেশসমূহের কাছে রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়িমুক্ত শহর করতে সহযোগিতা চাইলে আমার বিশ্বাস তারা দ্রুত এগিয়ে আসবে। সৎভাবে বিত্তবান হওয়া প্রবাসী ও দেশি ব্যবসায়ীগণ তাদের নিজ এলাকার শ্রমিকদের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন বলেও আমার বিশ্বাস। আর এতে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন সহজ হবে।
ভাসমান শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে তৈরি করে দেশের উন্নয়নের কাজে লাগানো এবং বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে বিদেশে আমাদের সুনাম ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও একটি গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হতে পারে।
লেখক: ব্যবসায়ী