আওয়ামী লীগের প্রাণ; গ্রামগঞ্জের সৃজনশীল নেতাকর্মী
৪ জুলাই ২০২০ ১৫:৫৭
নব্বই দশকে উপজেলা সদরে সরকারি কলেজে ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম। মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রচারে দেয়ালিকার কাজ করতাম। আর্ট পেপার কিনে দেয়ালিকা লিখে কলেজে টানিয়ে রাখতাম। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে মঞ্চ নাটকের আয়োজন করলাম। কলেজ শাখা ছাত্রলীগের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্বে থাকার সময় গফরগাঁও সরকারি কলেজের মাঠে রক্তাক্ত বাংলা নামে এই নাটকে অভিনয় করলাম একাত্তরের কুখ্যাত রাজাকারের ভূমিকায়।
বাবা ৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা, নব্বই দশকে রাজাকারের ভূমিকার আমার অভিনয়! নিজের কাছে একটু কেমন লাগলো। কিন্তু অভিনয় ভালও হওয়ার অভিনন্দন পাওয়ার পর ঠিক করলাম এসব নাটক সাধারণ মানুষদের দেখানো দরকার। তবে কিছুটা বাধাও ছিল। গফরগাঁও রেলওয়ে ষ্টেশনে পরপর দুটি মঞ্চ নাটক করে ফেললাম। ‘মুক্তিযোদ্ধার কেচকি মাইর’ নামে একটি নাটকেও ৭১ সালের রাজাকারের ভূমিকায় অভিনয় করতে হলো। নাটকের শেষ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারকে ধরে মারতে লাগলো। দর্শকদের করতালির স্রোত থেকে বুঝতে পারলাম বিএনপি জামায়াত কর্তৃক মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস মুছে ফেলার যে অপচেষ্টা চলছে। তা নিশ্চয় ক্ষণিকের।
ছাত্রলীগ রাজনীতি করার সময় দেখেছি, বিএনপি ক্ষমতার থাকাকালে ১৯৯৫ সালে কিভাবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সমর্থকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশ্যে টাকা পয়সা জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। সেই সময়কার বিএনপির সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ নাকি এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।
ইদানিং আমার ভাবনাগুলো ইতিবাচক। তাই নাম প্রকাশ করতে চাই না। যাক, উপজেলা সদরে বিএনপি পাড়া বলে চিহ্নিত তৎকালীন নাম কেজি স্কুল (বর্তমান আদর্শ শিশু নিকেতন)। এখানে গঠন করেছিলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ। আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করার সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচার দাবী করার নানা রকম প্রচারণা করা হয়েছিল। এ কাজে খুশি হয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ৫ হাজার টাকা অনুদান দিলেন সংগঠনের নামে ৷ উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে এই অনুদানের টাকা নিয়ে শুরু করলাম সাংস্কৃতিক কার্যক্রম।
অনেক বাধার পেয়েও স্বাধীন দেশে রাজাকার ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার দাবী করার কাজ ছিল মূল উদ্যোগ। পরে রৌহা গ্রামের তৎকালীন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মরহুম গিয়াস উদ্দিন চাচার পরামর্শে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম ছাত্র সাংস্কৃতিক কমান্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করি।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে ছাত্রলীগ সংগঠন ও স্থানীয় সাংবাদিক থাকার সময় ১৯৯৮ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায়দের পাশে কিভাবে দাঁড়াতে হয়। নদীতে নৌকায় করে হাঁটু পানিতে নেমে ত্রাণ দিয়েছি। প্রত্যক্ষ করেছি গণমানুষের দল আওয়ামী লীগকে মানুষ কি রকম পছন্দ করেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তৃণমূল আওয়ামী লীগের প্রাণ। হ্যাঁ, বাস্তবতাও তাই। গ্রাম গঞ্জের আওয়ামী লীগের সৃজনশীল নেতাকর্মীদের কিছু কথা বলছি। চরাঞ্চলের শামছুল হক। সবাই মাইক শামছু ভাই নামে ডাকেন। কারণ ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলের ওপারের শামছু ভাই হাট, বাজার, দোকানপাটসহ যেকোন স্থানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য দিতেন। আওয়ামী লীগের যেকোন সভা সমাবেশে প্রারম্ভিক বক্তব্য দিতেন তিনি। তাই শামছু ভাই কমিটির প্রচার সম্পাদক ছিলেন। দেখতাম, উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নৌকা নিয়ে লাঠি খেলোয়াড় দল নানা কসরত করতে করতে বাদ্য যন্ত্রের শব্দে মাইলের পর মাইল হেঁটে বিশাল মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে যোগ দেওয়া।
১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনার সময় যারা আমার নিজ এলাকার সুযোগ-সুবিধাভোগী ছিলেন তারা ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে হঠাৎ নীরব হতে লাগলেন। আমার নিজ গ্রামের চিত্র যদি বলি, এখানে কোন সময় নৌকা জয়লাভ করতে পারেনি। শুধুমাত্র ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে নৌকার জয়লাভ দিয়ে শুরু। এখন এই গ্রাম আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলা চলে৷ এক সময় মুসলিম লীগ অধ্যুষিত এই এলাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের হওয়ার পেছনে অনেক ইতিহাস। এই গ্রাম, ইউনিয়ন বা উপজেলার আওয়ামী লীগের সেই সব নেতাকর্মী ও সমর্থকরা লড়াই-সংগ্রাম করেছেন তার অনুভূতির সংগঠন আওয়ামী লীগের জন্য। এটাই তাদের আনন্দ। তারা আছেন এখনও।
এরপর ১/১১ সময় গ্রামগঞ্জের সংগ্রামী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী বা সমর্থকরা আওয়ামী লীগেই ছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তেমন পরিশ্রম হয়নি। নৌকার গণজোয়ার। দেখেছি, কিভাবে ঈদের আনন্দের মতো ভোটাররা নিজ এলাকায় নৌকা স্লোগান দিয়ে মুখরিত করেছিলেন ভোটের আগে। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াতের নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সোচ্চার ছিলেন। নির্বাচনের পর বিএনপি জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও সাধারণ নৌকা ভক্ত গ্রামগঞ্জের মানুষ সজাগ ছিলেন।
আগুনে পোড়া শিশু শিক্ষার্থী রাকিবের স্কুলে যাওয়া বন্ধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন করতে গিয়ে দেখতে পেলাম, মানুষ বিএনপি জামায়াতের সন্ত্রাস কিভাবে সমালোচনা করেন। অনেকে বললেন, বিএনপি জামায়াতের সন্ত্রাসী তাণ্ডব দেখেছি ২০০১ সালেই। যাক, গত জাতীয় নির্বাচনে আমি নিজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন পেশার মানুষের একটু ব্যতিক্রম বক্তব্য প্রচার করার সময় দেখেছি কত সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা রয়েছে তাদের৷ যেমন, একজন রিকশাচালক বললেন ‘আমার নেত্রী, আমার অহংকার’। এই কনটেন্ট ফেসবুকে দেওয়ার পর ভাইরাল হয়ে গেল। কারণ, গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের সহজ সরল অনুভূতি অনেকেই পছন্দ করেন।
এছাড়া আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত আমার উপজেলার তরুণ প্রজন্ম বর্তমানে সৃজনশীলতা পছন্দ করেন। শুধু লোক দেখানোর জন্য নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার বা আত্মকেন্দ্রিক করতে নয়, বাস্তব সৃজনশীল, বিজ্ঞান মনস্ক ও নতুন চিন্তাধারায় কাজ করতে চান তরুণরা। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন পছন্দ করে না তরুণ প্রজন্ম।
২০০১ সালে নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কলম সৈনিক থাকার অপরাধে মিথ্যা মামলায় জেল-হাজত খাটতে হয়েছিল। পাশে কাউকে পাইনি। ১/১১ সময় ছাড় পাইনি। মিথ্যা মামলায় জেল-হাজত। অবশ্য, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পরও নিজেকে কোন সুবিধাভোগীর তালিকায় নাম লেখাইনি কিন্তু। কোন পদ-পদবী নেওয়ার জন্য তদবির করিনি। আমি মনে করি, কোন কিছু চাওয়ার বা পাওয়ার নাই। কারণ, আমার অনুভূতির সংগঠন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এই সংগঠনের সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন বলেই আমরা সুরক্ষিত। এ কথা শুধু আমার নয়, গ্রামগঞ্জের আওয়ামী লীগের সৃজনশীল অসংখ্য নেতাকর্মীদের।
আওয়ামী লীগের গ্রামগঞ্জের একজন প্রয়াত নেতার কথা বলছি। গরিবের উপকার করতেন। সম্ভব নয়; এটা ভাবতেন না, উপকার করতেন কর্মীদের। পকেট থেকে টাকা বের করে দিতে দেখেছি। একদিন খাবার দোকানি নজরুল ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা আপনার ভাতের হোটেলের সবচেয়ে বড় কাস্টমার কে? তিনি বলেছিলেন, খোকা চেয়ারম্যান। অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করার পর বললেন, হরদম মানুষকে খাওয়ান। কেন, উত্তরে জানালেন, এমনেই। এই থেকে বুঝে নিতে হবে কতটা মানবিক মানুষ ছিলেন তিনি। তখন অবশ্য খোকা ভাই চেয়ারম্যান ছিলেন না। দেখতাম প্রায়ই অনেক দলীয় কর্মী খোকা ভাইয়ের বিরুদ্ধে খুব উত্তেজিত থাকতেন। ভাবতাম এভাবে বলছেন কেন। কৌতূহলী হওয়ার কারণে একটু কাছে গিয়ে দেখলাম ‘উত্তেজিত ওই দলীয় কর্মী খোকা ভাইয়ের সামনে যাওয়ার পর নরম। কত শান্ত। মনে হয় জীবনেও কোন ক্ষোভ বা রাগ ছিল না খোকা ভাইয়ের প্রতি।
অনেক ইতিবাচক ঘটনা আছে, লিখে শেষ করা সম্ভব না। জনবান্ধব, কর্মীবান্ধব ও দলবান্ধব ছিলেন অ্যাডভোকেট মীর আবু তালেব খোকা ভাই। ৫ বার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তৃণমূলের এই রাজনৈতিক ব্যক্তিকে কেন্দ্রীয় সবাই চিনতেন। বলতেন, গফরগাঁওয়ের খোকা চেয়ারম্যান। রাজনীতি, আইন পেশা ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। কখনই দলের মতাদর্শ থেকে আদর্শচ্যুত হননি এই মুক্তিযোদ্ধা।
ছাত্রলীগ করার কারণে নয়, মূলত পাশাপাশি সাংবাদিকতা করার কারণে একটা অভ্যাস ছিল, প্রশ্ন করা। একদা খোকা ভাইয়ের কাছে প্রশ্ন ছিল, আওয়ামী লীগের আপনারা প্রবীণ হচ্ছেন। কিন্তু একটা সময় তৃণমূলের ‘সেকেন্ড লাইন অফ ডিফেন্স কারা! খোকা ভাইয়ের মতো রাজনৈতিক নেতা আওয়ামী লীগের জন্য আগামী দিনে অনেক দরকার। কিন্তু আমার এলাকায় কয়জন খোকা ভাই বর্তমানে আছেন, একটু বলবেন?
গত জুন মাসে প্রাক্তন আ্যডভোকেট, আওয়ামী লীগ নেতা, ৫ বার নির্বাচিত গফরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা মীর আবু তালেব খোকা ভাইয়ের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল, মিথ্যা মামলা, নির্যাতন ও নিপীড়ন এসব নিজের চোখে অনেকেই প্রত্যক্ষ করেননি এখনকার নতুন প্রজন্ম! আমি নিজে ভুক্তভোগী। খালেদা, নিজামী সরকারের আমলে পুলিশের লাঠি ও মিথ্যা মামলার জেল হাজত, রিমান্ড এবং নিজ এলাকা ছেড়ে থাকা।
খোকা ভাইরা ছিলেন আমাদের নেতা। ইতিবাচক একটি বিষয় দিয়ে লেখার ইতি টানছি, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সালে ‘দিন বদলের এক বছর’ নামে উপজেলায় তৎকালীন সময়ের সরকারের চলমান উন্নয়ন বার্তা জনগণের মধ্যে পৌঁছানোর জন্য একটি প্রকাশনার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলাম। সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি ছিলেন খোকা ভাই। বইটি আছে, কিন্তু তৃণমূলের জনমানুষের এই নেতা নেই। তবে আমি দেখেছিলাম কিভাবে মানুষের মধ্যে এই আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন বার্তার প্রকাশনা তুলে দিতেন খোকা ভাই। কি চমৎকার মুখের হাসি ছিল দলের প্রতি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা