বাংলার রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তাজউদ্দীন আহমদ
২৩ জুলাই ২০২০ ১৬:৪৫
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও স্বাধীনতা যুদ্ধের অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের অনন্য নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক তাজউদ্দীন আহমদ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর তার নামটি চলে আসে অনিবার্যভাবে।
স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আগে ও পরে বাংলার রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তাজউদ্দীন আহমদের আজ জন্মদিন। ১৯২৫ সালের এই দিনে (২৩ জুলাই) ঢাকা শহর থেকে মাত্র ৮২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বর্তমান গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলার এই কৃতিসন্তান।
স্কুল জীবন থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন রাজনীতি সচেতন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন শান্ত, সংযমী, মিতভাষী, দায়িত্বশীল ও স্নেহপরায়ণ গুণের অধিকারী।
তাজউদ্দীন আহমদের পড়াশোনা শুরু বাবার কাছে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে। স্কুল জীবন শুরু হয় বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরের ভূলেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে৷ সেখান থেকে ১ম ও ২য় শ্রেণী শেষ করে ভর্তি হন কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তাজউদ্দীন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ প্রাইমারি স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মফিজউদ্দীন। তিনি স্কুলের এক অনুষ্ঠানে সব শিক্ষকের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘সে হলো গ্রেট স্কলার। সে হলো রত্ন। তার মাঝে আমি বিরাট ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি।’ (সূত্র: স্বকৃত নোমান- তাজউদ্দীন আহমেদ, পৃ: ১৮)। প্রধান শিক্ষকের সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়নি।
পড়ালেখা করেছেন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন, মুসলিম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়,ঢাকা ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বাংলা প্রদেশের একমাত্র বোর্ড কলকাতা বোর্ডে ১২তম স্থান অর্জন করেছিলেন তাজউদ্দীন। ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) থেকে অবিভক্ত বাংলার সম্মিলিত মেধাতালিকায় যথাক্রমে দ্বাদশ ও চতুর্থ স্থান (ঢাকা বোর্ড ) লাভ করেন।
১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মূল বিষয় অর্থনীতির পাশাপাশি তাজউদ্দীন আহমদ সাবসিডিয়ারি কোর্স হিসেবে অধ্যয়ন করেছিলেন ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান। পড়েছেন আইনশাস্ত্রও। ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় এল.এল.বি. ডিগ্রীর জন্য পরীক্ষা দেন এবং কৃতিত্বের সাথে পাস করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ পবিত্র কোরআনে হাফেজ ছিলেন, নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার সান্নিধ্যে কোরআন পাঠ করতেন তিনি।
খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ছিলেন গণতান্ত্রিক যুবলীগের নেতৃস্থানীয় সদস্য। মাত্র ২৮ বছর বয়সে জনপ্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান তাকে সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ম্যাগনা কার্টা বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসাবে খ্যাত ছয় দফা প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাজউদ্দীন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছিলেন সেদিনই সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন তাজউদ্দীন। সেই থেকেই শুরু হয় বাংলার রাজনৈতিক আকাশে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন জুটির পথ চলা। এই জুটির ঘনিষ্ঠতা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। তখন থেকেই শেখ মুজিবের কাছ থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে দূরে সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সামরিক সরকার। কারণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাজউদ্দীনকে সাধারণ কোনো রাজনৈতিক ভাবতো না। তাজউদ্দীনের প্রখর মেধা, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি এবং কৌশলকে ভয় পেতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে পার্লামেন্টারি বোর্ড সভাপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর সদস্য সচিব ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেই সময়ে প্রার্থী নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ও অবদান ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ করে ভারতের সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থন আদায় করেছিলেন তিনি। মুজিবনগর সরকার গঠন করেছিলেন তিনি। মুজিবনগর সরকার তথা বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। আর সর্ব শ্রদ্ধার আসনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে তাজউদ্দীনকে বিশেষ স্নেহ করতেন মাওলানা ভাসানী। তিনি তাজউদ্দীন সম্পর্কে বিনা দ্বিধায় বলতেন, ‘তাজউদ্দীন আমার যোগ্য ছেলে, ওর প্রতি আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট।’ (সূত্র: স্বকৃত নোমান- তাজউদ্দীন আহমেদ, পৃ: ৭৪)।
নির্লোভ এবং নিরহংকার এক অনন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাজউদ্দীন।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাত্র ২ মাস ১৮ দিনের মাথায় ঘটে যায় বাঙালির ইতিহাসের আরেক নির্মম ঘটনা। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫- জেল হত্যাকাণ্ড। সেদিন নির্মমভাবে শহীদ হন কীর্তিমান মহান পুরুষ বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ।
লেখক: উন্নয়নকর্মী