আমি নারী, আমিই রুখবো নির্যাতন
৩০ জুলাই ২০২০ ১৩:৩১
আমি একজন নারী। একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম আমার। তবে ইচ্ছা আছে জীবনে অসাধারণ কিছু করার। কিন্তু আমার এই ইচ্ছা কি কখনো পূরণ হবে? কথাটা বলার কারণ, আমি যে একজন নারী। নারী মানে কারো মা, বোন, স্ত্রী আরও অনেক সম্পর্ক। আর আমিই পারবো সবধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
আমাদের সমাজে নারীর অবস্থা খুবই করুণ। কথাটা বলার কিছু কারণ আছে। আসলে কিছু কারণ আছে বলাটা মনে হয় ভুল হলো। কথাটা বলা উচিত ছিল যে, অনেক কারণ আছে। ধরুন, একটি মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে যার পোশাক বেশ ভদ্রস্থ। কিন্তু সে একটু স্বাথ্যবান। বাস রাস্তায় চলাকালীন কিছু লোক তার পোশাক বা চালচলনে সমস্যা খুঁজে না পেলেও তাকে দেখে বাজে মন্তব্য করবে। কারণ মেয়েটি যে মোটা। কেউ বলবে দেখ দেখ ওই মেয়েটির পেছন কত মোটা। আবার কেউ কেউ পাশ থেকে বলবে, ও ম্যাডাম আপনি কোন দোকানের চাল খান। এমন আরও অনেক মন্তব্য। এখন আপনারাই বলুন, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কী মেয়েটির দোষ। না নিজের শারীরিক অবয়ব মেয়েটির দোষ। নানা কারণে মানুষ মোটা হতে পারে। কেউ কেউ হরমোনজনিত কারণেও মোটা হয়ে যায়। আর ওই মেয়েটির জায়গায় যদি একটি ছেলে থাকত তাহলে কি এমন মন্তব্য আসতো? উত্তরটা মনে হয় সবার জানা।
ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, তুমি যদি প্রকৃত মুসলিম হও তবে একজন নারী উলঙ্গ হয়ে তোমার সামনে নাচলেও তুমি তার দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। কিন্তু তারা ধর্মের নামে মেয়েদের উপর পোশাক চাপালেও পুরুষ হয়ে নিজেদের চোখ নিয়ন্ত্রণ করবে না।
এবার একটু অন্য কথায় আসি। স্বাধীন বাংলাদেশে সব মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু বাস্তবে কী তা মানা হয়? আচ্ছা মনে করেন একটি ছেলে একটি মেয়েকে তার সঙ্গে প্রেম করার জন্য প্রস্তাব দিল। এখানে ছেলেটি তার মনের ভাব প্রকাশ করল, কারণ তার সেটি করার স্বাধীনতা আছে। এখন মেয়েটি তাকে না বললো, কারণ তার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু ছেলেটি তা মানতে পারলো না। সে ভাবলো একটা মেয়ে হয়ে সে কীভাবে তাকে না করলো। ছেলেটির ইগোতে লাগলো। এই ইগোর কারণে অনেকে মেয়েদের মুখে অ্যাসিড মারে, খুন করে, আবার অনেকে ধর্ষণ করে।
ধর্ষণ বা রেপ কথাটা খুব ছোট শোনালেও এই ছোট্ট কথাই একটি মেয়ের ও তার পরিবারের জীবন নষ্ট করে দেয়। তাদের সব খুশিকে দুঃখে পরিণত করে। একজন নারী যে যৌন হয়রানির শিকার সে যদি প্রতিবাদ করে তবে ন্যায্য বিচার নয়, তার প্রাপ্য হয় মৃত্যু। কারণ কি জানেন? কারণ এই নষ্ট হয়ে যাওয়া সমাজ। ধরেন আপনার মেয়ে বা বোন যৌন হয়রানির শিকার হলো। আপনার প্রতিবেশীদের মন্তব্যে পরে আসি, আপনার পরিবারেই এমন কিছু লোক আছে যারা বলবে মেয়েরও দোষ আছে। আবার অনেকে বলবে ভাই মেয়েকে যদি পর্দার মধ্যে রাখতেন তবে এমন দিন দেখতে হতো না। আর যদি আপনার মেয়ে পর্দা করে তারপরেও ধর্ষিত হয়, তখন লোকজন কি বলবে জানেন, এক হাতে তালি বাজে না।
এ ধরনের লোকদের আমি বলতে চাই, চরিত্র ভালো কি মন্দ সে সার্টিফিকেট দেওয়ার আপনি কে? আর চরিত্রের দোহাই দিয়ে কি ধর্ষণকে জায়েজ করা যায় না। দেহব্যবসায়ী মেয়েরও নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য আছে। জোর করে তা হরণ করা যাবে না। এই সহজ বিষয়টি আমাদের সবারই বুঝতে হবে।
কেউ কেউ নিজের জীবনের অভিজ্ঞা দিয়ে পুরো মেয়ে জাতিকে খারাপ ভাবে। এটা মোটেও ঠিক নয়। আর একটি কথা, যারা মনে করেন এক হাতে তালি বাজে না তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন করুন। কারণ দুটো হাত দিয়ে তালি মারলে যে শব্দ হয় একটি হাত দিয়ে ঠাটায় একটি চড় মারলে কিন্তু তার থেকে বেশি শব্দ হয়।
অনেক সময় খবরের কাগজ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্যান্য মাধ্যমে শোনা যায় যে শিশু ধর্ষণ করা হয়েছে। শিশুটির বয়স ৩ থেকে ৫ বছর। এই যারা শিশু ধর্ষণ করে এদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন, ‘তোদের এতো ফিলিং কোথা থেকে আসে? ৩ বছরের একটি বাচ্চার কী দেখে তোদের এতো উত্তেজনা আসে?’ আচ্ছা এরা তো পিশাচ, কিন্তু কখনো যদি শোনেন যে আপনার মেয়ে বা বোন যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে তার শিক্ষক দ্বারা, কেমন লাগবে তখন?
এবার আপনি যদি আপনার মেয়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যান বিচার চাইতে তাহলে দেখবেন প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক না হোক অধিকাংশ শিক্ষক ওই শিক্ষিত পিশাচটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। আর এই চেষ্টা সফল করতে গিয়ে যদি আপনার মেয়ে বা বোনকে চরিত্রহীনা বানাতে হয় তাও তারা করবে। কারণ ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যে খারাপ সেটা প্রমাণিত হলে যে ওই প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা নষ্ট হবে। আর এই কর্মে শুধু শিক্ষক না কিছু শিক্ষার্থীও নিজেদের স্বার্থের জন্য দায়ী শিক্ষককে সমর্থন করবে।
তবে আমি বলছি না সব শিক্ষক খারাপ। অনেক শিক্ষক আছে যারা আপনার চলার পথটাকে প্রশস্ত করে সঠিক শিক্ষা দিয়ে। তবে শিক্ষকের হাতে নির্যাতিত হয়েছে এমন ঘটনা স্কুল, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষর্থীদের সঙ্গে বেশি হয়। আর অনেক মেয়ে এটির প্রতিবাদ করে না। কারণ প্রথমত, তাদের কাছে কোনো প্রমাণ থাকে না। এ দুনিয়াতে প্রমাণ ছাড়া তোমার কথা কেউ শুনবে না। দ্বিতীয়ত, নিজের ও পরিবারের সম্মান নষ্ট হবে এটা ভেবে। তৃতীয়ত, মানুষ তাকে ভালো চোখে দেখবে না এটা ভেবে। এমন আরও অনেক কারণ আছে।
যাইহোক যদি কোনো মেয়ের কাছে প্রমাণও থাকে এবং সে যদি প্রশাসনের কাছে যায় তাহলে কিছু লোকের ক্ষমতার দম্ভে চাপা পড়ে যায় সকল প্রমাণ প্রতিবাদ, এমনকি মেয়েটির জীবনও। মেয়েটি একজন নিরুপায়, নিঃস্ব মানুষের থেকেও অসহায় হয়ে পড়ে। তখন আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথ থাকে না।
এগুলো ভাবলে নারী হয়ে জন্মেছি বলে কিছুটা আফসোস হওয়ার কথা। কিন্তু না, আমি নারী আর আমি এজন্য গর্বিত। নারীর আছে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা। এই গর্ভেই যেমন বঙ্গবব্ধুর মতো কৃতি সন্তান জন্মে তেমনি জন্ম নেয় কিছু মানুষরূপী জানোয়ার। নারীকে বলছি, তুমি সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখ, প্রয়োজনে কিছু কুলাঙ্গার সন্তানদের ধ্বংস করার ক্ষমতাও তোমার থাকা উচিত। আবার একইসঙ্গে একজন মা তার ছেলে সন্তানকে নারীদের শ্রদ্ধা করতে শেখাতে পারে। পারে একজন সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়তে। আবার ঘরে যদি নারীর প্রতি অন্যায় করা হয়, তা দেখে একজন ছেলে সন্তানের একইরকম মানসিকতার হয়ে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে। তাই নারীকে ঘরেই প্রতিবাদ শুরু করতে হবে। ছেলে ও মেয়ে সন্তানকে সমান চোখে দেখতে হবে। এভাবে একজন মা তার সন্তানদের সমঅধিকারে বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। পারেন নিজের কন্যা সন্তানকে প্রতিবাদী হিসেবে গড়তে।
নারী বলে তার উপর ক্ষমতা দেখানো বন্ধ হোক। বন্ধ হোক সকল ধরনের নারী নির্যাতন। কারণ, নিজের মাতৃভূমি রক্ষা করার জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যুদ্ধ করেছিলো, তারাও অস্ত্র ধরেছিলো। এখন নিজের সম্মান রক্ষা করার জন্য যে সেই নারী আবার অস্ত্র হাতে নেবে না সে কি বলা যায়। তখন, নির্যাতনকারী পুরুষ পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।
এবার আসি আমার কথায়। আমি আমার মায়ের কাছে শিখেছি অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ কিভাবে করতে হয়। তার উপর আমি আবার বীরের দেশে জন্ম গ্রহণ করেছি। আমার উপর অন্যায় হলে আমি সহ্য করবো না। চরম প্রতিবাদ করবো। হোক সে শিক্ষক, শিক্ষার্থী বা অন্য মানুষ। অন্যায় করলে প্রতিবাদ হবে। শেষ কথা, কারো প্রতি অন্যায় হয়েছে শোনে শুধু ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে দুঃখ প্রকাশ নয়। প্রয়োজনে রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করতে হবে।
লেখক- শিক্ষার্থী, খুলনা টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট
[email protected]