Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম ও বাস্তবতা


২ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৫১

করোনা মহামারিতে পরিবর্তনশীল এই জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষার ধারাটিও পরিবর্তন হয়েছে। থমকে যাওয়া পুরো বিশ্বের সামনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করাও এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যেখানে সবাই আতঙ্কিত নিজেদের জীবন রক্ষা নিয়ে। করোনার প্রভাব যেমন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক জনজীবনের উপর প্রভাব ফেলছে তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রেও চরম প্রভাব ফেলছে। গত ২৬শে মার্চ থেকে দেশের স্কুল-কলেজ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা ভর্তি কার্যক্রম চালু রাখা হয়। পহেলা এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।

শিক্ষাই পারে দেশকে, জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, সেখানে শিক্ষাব্যবস্থাই আজ বিপাকে। যদিও অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলছে তবুও এটি কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে সকলেরই প্রশ্ন রয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষাদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অনিশ্চিত এই পরিস্থিতিতে অনলাইন কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও ইউজিসি। ইতিমধ্যে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা পরিচিত হচ্ছে নতুন এক অধ্যায়ের সাথে। প্র্যাকটিকেল ক্লাস, পরীক্ষা, গতানুগতিক শিক্ষা থেকে দূরে থেকে নতুন শিক্ষাধারায় সম্পৃক্ততায় শিক্ষার্থীরা কতটুকু উপকৃত হচ্ছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে অনেকেরই মনে। অনলাইন ক্লাস শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন বিষয় যা বৈশ্বিক মহামারির কারণে সকলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মূলত শিক্ষার্থীদের অনলাইন টিউটোরিয়াল বা জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে ও নিয়মিত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এই অনলাইন ক্লাসের পাঠদান গ্রহণের ক্ষেত্রেও অনীহা রয়েছে অনেকের মাঝে। অনলাইন ক্লাসের মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শিক্ষাব্যবস্থা যেন এই মহামারিতে মুখ থুবড়ে না পড়ে– যা দেশের জন্য অতি জরুরি।

অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে এই মহামারিতে জীবন যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাবনা  কতটা  প্রাসঙ্গিক। এই প্রশ্নের উত্তর ও গভীরভাবে চিন্তা করলে পাওয়া যায়। মহামারি আসবে যাবে, এখন শুধু কাটিয়ে ওঠার অপেক্ষা কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির হয়ে গেলে সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে পড়া রোধ করতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

করোনা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে সংশয় রয়েছে। কেমন হবে তাদের শিক্ষাক্রম? কতটুকু পরিবর্তন আসবে তাদের শিক্ষা ধারায় এটি তাদের প্রশ্ন। অন্যদিকে সেশনজট নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে ভয়টা আরও বেড়েছে এই মহামারি পরিস্থিতিতে। দুশ্চিন্তায় রয়েছে পরিবার।  সন্তান শিক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে এ আশা সকল বাবা-মায়ের তবে বর্তমানে এই আশা অনেকটা নিরাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাদের।

কবে ফিরবো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীতল ছায়ায় ? এই প্রশ্ন নিয়ে দিনযাপন করছে প্রতিটি শিক্ষার্থী। অনলাইন শিক্ষাক্রম শুরুর সাথে সাথে এর উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। তবে শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল রাখতে এই কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে অনলাইন শিক্ষা নিয়ে কিছু প্রশ্ন সকলের মনেই থেকে যায়। প্রশ্নগুলো অগ্রাহ্য করার মতো নয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় অনলাইন ক্লাসের সুফল উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে আরও বেশি করে পরিচিত হচ্ছে যা তাদের দক্ষতাকে বৃদ্ধি করছে। শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় যেমন নষ্ট হচ্ছে না, অন্যদিকে মানসিক চাপ কিছুটা কমছে শিক্ষার্থীদের। অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষকরা কোর্স প্লান অনুযায়ী পড়াচ্ছেন,  পাশাপাশি বিভিন্ন শিট, নোট শেয়ার করছেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ নয় এমন শিক্ষার্থীও এখন তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে উঠছে ফলে অনলাইনে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন কোর্স করছে শিক্ষার্থীরা।

যদিও অনলাইন ক্লাস সরাসরি ক্লাসের বিকল্প হিসেবে কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে তবুও এটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি শিক্ষাব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রূপ না হলেও আংশিক হিসেবে সচল রাখছে শিক্ষাব্যবস্থাকে।

নতুন ধারার শিক্ষাব্যবস্থার কিছু প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৬৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৭ হাজারের মতো মাধ্যমিক বিদ্যালয়, দুই হাজার পাঁচশ কলেজ ও সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে যুক্ত করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এছাড়া বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার সকলের মাঝে সমানভাবে হয়নি। অনলাইন ক্লাসের অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডিভাইস সমস্যা। শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে।

বিবেচনা করতে গেলে প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক পরিবারের কাছে টিভি সেট নেই যার ফলে বঞ্চিত হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সিংহভাগ শিক্ষার্থী। এছাড়া যদি উচ্চস্তরের শিক্ষার্থীদের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই অনেক শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ না থাকায় ক্লাসের আওতায় আসতে পারছে না। সামর্থ্য না থাকায় অনেকেই এটি ক্রয় করতেও পারছে না। যদি ঋণ প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ডিভাইস কেনার প্রশ্ন আসে তাহলে উপলব্ধির বিষয় হলো তাদের উপর ঋণ পরিশোধের বোঝা থেকেই যাচ্ছে যার ফলে আগ্রহী হচ্ছে না অনেকেই। বর্তমানে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে দেখা যায়, জীবন যুদ্ধে ব্যস্ত পরিবারকে সাহায্য করতে যেয়ে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধ যথেষ্ট ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাস এর সুবিধার দিক বিবেচনা করা যাবে না। আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল নয় এমন পরিবারের জন্য অনলাইন ক্লাসের খরচ চালানো কষ্টসাধ্য যেখানে এই পরিস্থিতিতে অনেকেরই ঠিকমত দু’বেলা খাবারের যোগান হয় না। অনলাইন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি হচ্ছেনা আশানুরূপভাবে। যার মূল কারণ হচ্ছে নেটসংযোগ। আর্থিক দিক দিয়ে সক্ষম শিক্ষার্থীরা অনেকে দুর্বল নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থার কারণে উপস্থিত হতে পারছে না ক্লাসে। গ্রামের শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার জন্য ঘরের অথবা বাড়ির বাইরে যেতে হয় যা তাদের জন্য অস্বস্তির বিষয়। তবুও শিক্ষকের কথা অনেকেই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেনা ফলে তাদের শিক্ষার মাঝে অসম্পূর্ণতা থেকেই যাচ্ছে। এছাড়া রয়েছে ডেটা  প্যাক-এর মূল্য ও মেয়াদ। ডেটা  প্যাকেজের উচ্চমূল্য  নিরুৎসাহিত করছে শিক্ষার্থীদের। ক্লাসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর একত্রে সক্রিয় থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইন ক্লাসের ক্ষেত্রে এটি কতটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। টিভি ও রেডিওতে শিক্ষাদান কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা নীরব দেখেই যায় প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই তাদের। শহর ও গ্রাম অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক ব্যবধান ঘটছে অনলাইন শিক্ষাক্রমের ফলে। পরিবর্তনশীল শিক্ষা কার্যক্রমে শহরের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গ্রামের শিক্ষার্থীরা সমানভাবে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। পিছিয়ে পড়ছে সুযোগ-সুবিধার অসামঞ্জস্যতার কারণে, ফলে অনেকটা শিক্ষা বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।

শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে আশা নিয়ে অনলাইন শিক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবে কতটা কার্যকর হচ্ছে তা ভাবনার বিষয়। এটি গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যবধান বাড়িয়ে অনেকটা আশঙ্কায় ফেলছে সবাইকে। অন্যতম উদ্বেগের বিষয় হলো স্বাস্থ্যঝুঁকি। দীর্ঘ সময় ধরে অনলাইন ক্লাস করার ফলে শিক্ষার্থীদের চোখের ক্ষতি হতে পারে বলে চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন।

সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতার কারণে অনলাইন শিক্ষার সুবিধাগুলো অনেকাংশে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। কতদিন চলবে এই মহামারি তাও আমরা কেউই জানিনা। এমন অবস্থায় সকলেরই দুশ্চিন্তা রয়েছে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থায় কবে ফিরবে তা নিয়ে। এই দিক বিবেচনা করে অনলাইন ক্লাসের অন্যতম সুবিধা হলো দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দি থাকা ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছে। আমরা গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার অপেক্ষায় থাকলে পিছিয়ে পড়বে শিক্ষার্থীরা। এসব দিক বিবেচনা করে অনলাইন শিক্ষা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে অনলাইন ক্লাস এর ক্ষেত্রে যে সকল প্রতিবন্ধকতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর সমাধান না করা গেলে অনলাইন ক্লাসের সফলতা দাবি করা যায়না। এক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠে অতি দ্রুত অনলাইন ক্লাসকে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর বান্ধব করতে হবে। সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণের দিকে আমাদের আগ্রহী হতে হবে কেননা পরিস্থিতি বিবেচনায় পরিবর্তনশীল সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের পরিচয়। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে তাহলে শিক্ষা বৈষম্য অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

করোনাভাইরাস


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর