প্রসঙ্গ জেল হত্যাকাণ্ড; এখনো থামেনি ষড়যন্ত্রের ধারা
৩ নভেম্বর ২০২০ ১৪:৫১
সভ্যতার ইতিহাসে বেদনাময় কলঙ্কিত দিন ৩রা নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালায় ঘাতকরা। কেড়ে নেয় বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ চার ঘনিষ্ঠ সহচর, জাতীয় চার নেতা— বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান-এর জীবন।
জাতীয় এই চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবন রাজনৈতিক সহকর্মী। পাকিস্তানের শোষণ আর শাসনের বেড়াজাল থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীনতার দোরগোড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী এই চার নেতা। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, আন্দোলন-সংগ্রামে এই চারজন ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে পাশে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।
মূলত ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা। দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই ছিল রাজনৈতিক। কারাগারের অভ্যন্তরে এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ঘাতকদের মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামিয়ে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করা। এই হত্যাকাণ্ডের কারণে যে নেতৃত্ব শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা হাজার বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।
জাতিকে মেধাশূন্য করাই শুধু নয়, হত্যাকারীদের রক্ষা এবং পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন ,বিদেশি দূতাবাসে পদায়নের মাধ্যমে ইতিহাসকে আরও কলঙ্কিত করেছেন জিয়াউর রহমান। জাতির পিতাকে হত্যা করার পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুরু হয় হত্যা, ক্যু-ষড়যন্ত্র , চক্রান্তের রাজনীতি। রাজনীতির আঁকাবাঁকা পথে যার ধারাবাহিকতা এখনো বহমান। এখন পর্যন্ত যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেনি, জয় বাংলা স্লোগান শুনলে যাদের গায়ে জ্বর আসে, লাল সবুজের পতাকার পরিবর্তে এখনো চাঁনতারা পতাকার স্বপ্ন দেখে যারা, যাদের চিন্তা-চেতনা আর ভালোবাসা পেয়ারে পাকিস্তানকে ঘিরে, তারা কি থেমে থাকার পাত্র?
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যদি বেঁচে না থাকতেন তাহলে পাকিস্তানের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হয়ে যেতো অনেক আগেই। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরার পর আবার নতুন করে জেগে ওঠার স্বপ্ন দেখে মুক্তিকামী বাঙালি। হয়তো মহান সৃষ্টিকর্তা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন দুঃখী বাঙালির মুখে হাসি ফোটানো আর বিচারহীনতা সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে।
শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার কারণেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে বাতিল করে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে দায়মুক্তি ঘটছে বাঙালির। প্রশ্ন, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও বাংলাদেশকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে কতটা ঝুঁকিতে আছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা? ঘাতকের বুলেট সবসময় তাক করে বেড়ায় বাঙালির আস্থা, ভালোবাসা আর বিশ্বাসের শেষ ঠিকানা শেখ হাসিনাকে। একবার নয় , দু’বার নয় ১৯ বার শেখ হাসিনার প্রাণনাশের চেষ্টা চালায় ঘাতকরা। কারণ বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পরও তাদের মিশন বাস্তবায়নে এখনো পাহাড়সম বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা বিবেচনা করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে যেনো আর কোনোদিন পাকিস্তানের এজেন্টরা স্বপ্ন দেখতে না পারে সে লক্ষ্যে সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে হবে। তালিকা তৈরি করতে হবে স্বাধীন দেশে লুকিয়ে থাকা বাঙালির ছদ্ম-আবরণে পাকিস্তানি টিকটিকিদের।
ভবিষ্যতে যেনো আর ১৫ আগস্ট, ৩ রা নভেম্বর আর ২১ আগস্টের মত নৃশংস ঘটনা না ঘটে সে লক্ষ্যে কমিশন গঠন করে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। আগামী প্রজন্মের কাছে এই খুনি ও তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা যারা বাস্তবায়ন করতে চায় তাদেরকে ঘৃণিত হিসেবে পরিচয় করে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা। তাদের স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা— যাদের ত্যাগ যুগে যুগে আমাদের বলীয়ান করবে শত সংকট মোকাবেলায়, আর অন্ধকারে দেখাবে মুক্তির পথ।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক ছাত্রনেতা