Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভূমি আইন ২০২০: জটিলতা কমবে নাকি আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা বাড়বে?


৬ নভেম্বর ২০২০ ১৭:৩৪

বাংলাদেশের ভূমি আইনে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করতে প্রস্তাবিত হচ্ছে ভূমি আইন ২০২০। প্রস্তাবিত আইনটি শুধু ভূমি বা সরকারি জমি নয় বরং নদী ও সাগরতীর, হাওর, খাল, বিল, জলাশয়, বনভূমি, গোচারণ ভূমি, রেলের জমি, সায়রাত মহাল, জলমহাল, চিংড়িমহাল, বালুমহাল, পাথরমহাল, হাটবাজার ব্যবস্থাপনা, ফেরিঘাট ইত্যাদির ব্যবস্থাপনা নতুন এই আইনটির আওতায় থাকবে। দীর্ঘদিন ধরে চলা ২২টি আইন বাতিল করে বাংলাদেশের আইনের ইতিহাসে নতুন করে যায়গা করে নিচ্ছে ২৭৪ ধারা বিশিষ্ট এই আইন। তবে যেসব মোকদ্দমা পূর্বের আইনে দায়ের করা হয়েছে তা পূর্বের আইনানুযায়ী নিষ্পত্তি করা হবে।

বিজ্ঞাপন

গত ১০ ফেব্রুয়ারি ইমেইলের মাধ্যমে আইনজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মতামত চেয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন কমিশন। এ আইন বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলেও দাবি করে কমিশন। দেওয়ানী আদালতে প্রায় ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ২ লাখেরও বেশি মোকদ্দমা ঝুলন্ত রয়েছে, যা সহজে নিষ্পত্তি করতে এ আইন প্রস্তুত করা হয়েছে। আসলে এ আইন মোকদ্দমার জটিলতা কমাবে নাকি আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা বাড়াবে? আইনটি সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা, দেওয়ানী কার্যবিধির ৯ ধারা এবং সংবিধানের ২৭ ও ৩১ ধারার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

বিজ্ঞাপন

আইনকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের আমলাদের কাছে। যারা আইন বিষয়ে ততটা বিজ্ঞও নন। আইন বিষয়ে বিসিএস পরীক্ষায় দু-চার লাইন আর সংবিধানের কয়েকটা অনুচ্ছেদ ব্যতীত অন্যান্য আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। অজ্ঞদের হাতে বিজ্ঞ আইন ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একজনের কাছে এত বড় এক আইন ছেড়ে দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যদি এমনি করতে হতো তাহলে দেওয়ানী আদালতের প্রয়োজন পড়ত না বললেই চলে। ভূমি সম্পর্কিত মোকদ্দমা নিষ্পত্তি ও ভূমি আইনে দক্ষতা গড়তে দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের নির্দেশনায় আইনের পাশাপাশি ভূমি আইন পড়ানো হচ্ছে। নির্বাহী বিভাগে এসব আইন পরিচালিত হলে এই বিভাগ খোলার প্রয়োজনই বা কী ছিল?

এ আইন নিয়ে ইতোমধ্যে আইনজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর ‘ভূমি আইন-২০২০’ কালো আইন আখ্যা দিয়ে আইন বাতিলের দাবিতে মানবন্ধন করেছে লক্ষ্মীপুরের আইনজীবীরা। তাদের দাবি এ কালো আইনটি (ভূমি আইন-২০২০) প্রণীত হলে দেওয়ানি আদালতে সার্বভৌম ক্ষমতা বহু অংশে খর্ব হবে। এ আইন কতটা কার্যকরী বা সুফল বয়ে আনবে তা প্রশ্নবিদ্ধ।

ভূমি আইনের ৫ ধারায় ২ বছরের মধ্যে ইউনিয়ন, থানা ও জেলা পর্যায়ে জরিপের নির্দেশনা দিয়েছে ও ১০ ধারায় ১০ বছর পর জরিপের ইঙ্গিত দিয়েছে কমিশন। ১০ বছরের আগে দ্বিতীয় জরিপ করাও যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে আইনটিতে। বাংলাদেশের জরিপ এত তাড়াতাড়ি আদৌ সম্ভব কিনা প্রশ্ন থেকেই যায়। আর জরিপের নির্ধারিত সময়ও অযৌক্তিক বলা যায়।

এদিকে ১৭ ধারায় বলা হয়েছে যেসকল মৌজায় দেওয়ানী মোকদ্দমা রয়েছে সেসব এলাকায় নতুন মোকদ্দমা নেবে না ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু আমরা দেখি ভূমির গায়ে গায়ে একেক ধরনের মোকদ্দমা লেগেই থাকে। গঠিত এই ট্রাইব্যুনাল ব্যতীত অন্য কোথাও মোকদ্দমা করা যাবে না বলেও উল্লেখ রয়েছে আইনে। এই ট্রাইব্যুনালের দায়িত্বশীলরা সামলাতে পারলে ভালো। নতুবা জট বাড়বে।

ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে এ আইন। সাবালকত্ব আইন-১৮৭৫ এ বলা হয়েছে, ১৮ বছর বয়সে একজন মানুষ সাবালকত্ব লাভ করে। তবে এ আইনের ৬৭ ধারা বলছে ২১ বছর বয়স না হলে সে ভূমি হস্তান্তর অযোগ্য বলে বিবেচ্য। ১৮ বছর বয়সে কোনো ব্যক্তি সাবালকত্ব অর্জন করে। ২১ বছরের আগে সম্পত্তি হস্তান্তর অযোগ্য বিষয়টি বিবেচ্য নয়।

আইনটির ৩৬ ধারা তো ভয়ংকর। খতিয়ান জমির মালিকানার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল। বলা হয়েছে, চূড়ান্ত প্রকাশিত খতিয়ান সম্পর্কে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ বা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল ছাড়া অন্য কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। যার অর্থ— ডিসি নিয়ন্ত্রিত কর্তৃপক্ষ যা বলবে, সেটাই শেষ। আদালতের এখতিয়ার খর্ব করার সুস্পষ্ট প্রস্তাব।

আইনটির ১৬৮ থেকে ১৭৬ ধারা বলছে, সরকারি জমি, পতিত জমি ও গণব্যবহারযোগ্য জমির বিষয়ে ডিসি ও ইউএনওর সিদ্ধান্তই শেষ কথা। সংক্ষুব্ধ মানুষ আদালতে যেতে পারবে না। বলা হয়েছে, এসব জমির বিষয়ে আদালতের এখতিয়ার নিষিদ্ধ করা হলো। যেখানে যা বিচারাধীন আছে, তা আইনটি জারির তারিখে স্বয়ংক্রিয় বিলুপ্ত হবে। আইনটি সায়রাত মহালের বিষয়ে বলেছে, সরকারের অধিকার খর্বে কোনো আদালতে মামলা চলবে না।

খসড়া আইনটির ধারা ২৬৩ থেকে ২৬৮ পর্যন্ত ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি, ট্রাইব্যুনাল গঠন, আপিল, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। ডিসি, এডিসি, এসি ল্যান্ড, ও সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসারের সমন্বয়ে এ ট্রাইব্যুনাল পরিচালিত হবে। এই ট্রাইব্যুনালকে ভূমির ভুল রেকর্ড, বণ্টন সীমানা বিরোধ, অবৈধ দখল এবং জবর দখল বিষয়ে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এতে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ডিসির ক্ষমতায়ন ঘটানো হচ্ছে। যা ঐতিহ্যগতভাবে দেওয়ানী আদালতের এখতিয়ার, সেসব ডিসির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে।

এই ট্রাইব্যুনালকে ভূমির ভুল রেকর্ড, বণ্টন সীমানা বিরোধ, অবৈধ দখল বিষয়ে এবং জবর দখল বিষয়ে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে দেওয়ানী আদালত ও সুপ্রিম কোর্ট কোনো মামলা গ্রহণ বা শুনানি করতে পারবে না। এখানে স্পষ্টভাবে দেওয়ানী আদালতের অধিকার খর্ব করে নির্বাহী বিভাগকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর